স্মার্টফোন যে আধুনিক জীবনে এক অপরিহার্য প্রযুক্তি, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বর্তমানে এটি প্রয়োজন ছাড়াও অবসর, আড্ডা কিংবা পারিবারিক সময় কাটানোর মধ্যেও জেঁকে বসেছে। শিশু থেকে শুরু করে বয়োজ্যেষ্ঠ সবাই এখন এই আসক্তিতে মশগুল।
যে বয়সে তরুণদের মাঠে খেলাধুলা করার কথা, প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড় হওয়ার কথা, কিংবা মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটানোর কথা—সে বয়সেই তারা ডুবে আছে মুঠোফোনের স্ক্রিনে। প্রকৃতির সৌন্দর্য, ভোরের সূর্যোদয়—এগুলো যেন আজকের প্রজন্মের কাছে বিস্মৃত এক অধ্যায়। কারণ, গভীর রাত পর্যন্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা তাদের মধ্যে বেড়েই চলেছে। এ আসক্তি শুধু ব্যক্তি নয়, পরিবারকেও করছে ক্ষতিগ্রস্ত। অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে প্রিয়জনের ফিরে আসার জন্য একসঙ্গে সময় কাটাবে বলে। কিন্তু সে ঘরে ফিরেও ডুবে থাকছে ফোনের দুনিয়ায়। এতে করে পারিবারিক সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে দূরত্ব ও মানসিক বিভাজন। আধোরাতে যদি ঘুম ভেঙে যায় তাদের মনে পড়ে না বাবা কিংবা মায়ের কথা, তাদের মনে পড়ে হাতের প্রিয় স্মার্টফোনটির কথা।
শিক্ষাঙ্গনেও এর বিরূপ প্রভাব স্পষ্ট। ক্লাসের ফাঁকে যেখানে শিক্ষার্থীদের বই নিয়ে আলোচনা করার কথা, সেখানে তারা ডুবে থাকে অনলাইন জগতের ভার্চুয়াল গহ্বরে। তারা যে আগামী প্রজন্মের দায়িত্বপ্রাপ্ত নাগরিক, দেশ ও জাতিকে কী উপহার দেবে—তা সহজেই অনুমেয়। ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে যারা, আগামীর কর্ণধার যারা, তাদের এরূপ দশা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়াটাও বোধহয় অস্বাভাবিক নয়।
স্মার্টফোন এখন আর মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই, বরং মানুষকেই নিয়ন্ত্রণ করছে যন্ত্রটি। সামান্য অবসরে, এমনকি ব্যস্ততার মধ্যেও একবার না একবার স্ক্রিনের দিকে তাকানোর প্রবণতা জন্ম নিচ্ছে। এটি এখন শুধু প্রযুক্তি নয়, এক ধরনের আসক্তি—যা মাদক কিংবা ক্যাফেইনের মতোই ভয়াবহ। স্মার্টফোনের কারণে মানুষের মাঝে হতাশা, আকাঙ্ক্ষা, আক্ষেপ বিষয়গুলোও লক্ষণীয়, যা মানসিকভাবে অশান্তির সৃষ্টি করছে, ধ্বংস করছে শান্তি, সৃষ্টি করছে নানাবিধ সমস্যা। মেধা বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে স্মার্টফোন আসক্তি। কেননা, প্রকৃতির মুক্ত হাওয়া অনুভব কিংবা সবুজ প্রকৃতিতে চোখ রাখার সুযোগ তাদের মেলে না। শুধু মেধার বিকাশই বাধাগ্রস্ত হয় না, স্বাস্থ্যহানিও ঘটে। একাধারে স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, লেখাপড়ায় অমনোযোগী হতে দেখা যায় এবং একা থাকার প্রবণতা বাড়ে। এ প্রবণতা একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়। রাতের আকাশে তারাদের মেলা কিংবা চাঁদের আলো দেখার শখটাও তাদের আর নেই। কেননা তারা ডুবে আছে প্রাণপ্রিয় স্মার্টফোনটির অতল গহ্বরে, যা আমাদের হৃদয়কে ব্যথিত করে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ সমাজ এক অন্ধ, যান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিকতায় রূপ নেবে। পরিবারের সব সদস্যকে সজাগ থাকতে হবে। এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো সম্পর্কে আসক্ত ব্যক্তিকে জানাতে হবে। এরূপ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সাপ্তাহিক সেমিনারের আয়োজন করতে হবে এবং খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা, সম্পর্কের গুরুত্ব এসব বিষয় সম্পর্কে অবগত করতে হবে। এখনই প্রয়োজন সচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা। নইলে স্মার্টফোনের এ নীরব আগ্রাসন সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
নাহিন অরিদা নীলা, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন