সোমবার, ১৮ আগস্ট ২০২৫, ৩ ভাদ্র ১৪৩২
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যুবকদের হাতেই গড়ে উঠবে বাংলাদেশ

যুবকদের হাতেই গড়ে উঠবে বাংলাদেশ

আজ (১২ আগস্ট) জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক যুব দিবস। আন্তর্জাতিক যুব দিবস জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত একটি সচেতনতামূলক দিবস। দিবসটি ২০০০ সালের ১২ আগস্ট প্রথম উদযাপিত হয়। এটি বিশ্বব্যাপী যুব বিষয়গুলোর প্রতি সরকার এবং অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশের যুববিষয়ক মন্ত্রীদের বিশ্ব সম্মেলন ৮ থেকে ১২ আগস্ট ১৯৯৮ সালে পর্তুগালের লিসবনে এর প্রথম অধিবেশনে, ১২ আগস্টকে আন্তর্জাতিক যুব দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরে এ সুপারিশটি ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৯৯ তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়।

বাংলাদেশে পূর্ববর্তী বছরগুলোতে জাতীয় যুব দিবস এবং আন্তর্জাতিক যুব দিবস আলাদা তারিখে পালন করা হতো এবং আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হতো। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাতীয় যুব দিবস, যা (১ নভেম্বর) পালন করা হতো ও আন্তর্জাতিক যুব দিবস (১২ আগস্ট)—প্রতি বছর ১২ আগস্ট একসঙ্গে পালন করা হবে এবং একই প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশ্বের সব দেশের সরকারের মধ্যে দেশগুলোর যুবকদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য সচেতনতা তৈরি করা এ দিবসের লক্ষ্য। যুবসমাজ ঘিরে সাংস্কৃতিক এবং আইনি সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা দিবসটির উদ্দেশ্য। বিশ্বের সব দেশকে সচেতন করা যে, যুবকদের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন আছে। তাদের শিক্ষা থেকে স্বনির্ভর হওয়ার পথে তাদের সাহায্য করা সরকারের কর্তব্য। এ উপলব্ধি করতে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালিত হয়। প্রতি বছর, আন্তর্জাতিক যুব দিবসে তরুণদের প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলো এবং বিশ্বব্যাপী উন্নয়নে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রতিপাদ্য গ্রহণ করা হয়—‘আন্তর্জাতিক ও জাতীয় যুব দিবস যুব দিবস-২০২৫’: প্রযুক্তিনির্ভর যুবশক্তি, বহুপাক্ষিক অংশীদারত্বে অগ্রগতি।

বাংলাদেশের জন্য যুব দিবসটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই তরুণ ও যুবক। তারাই উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রকৃত কারিগর। এ প্রেক্ষাপটে দিবসটি উপলক্ষে তরুণ ও যুবসমাজকে মাদকসহ ক্ষতিকর নেশা, ইভটিজিং, যৌতুক, নারী নির্যাতন ও তামাকমুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্ট আইনগুলোকে শক্তিশালীকরণের জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন।

বিশ্বে এবং বাংলাদেশে যত ইতিবাচক অর্জন, আন্দোলন, সংগ্রাম, বিজয়, সংস্কার ও সাফল্যের জয়যাত্রা—তার নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্র, তরুণ ও যুবসমাজ। মহান মুক্তিযুদ্ধ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। এই যুব জনগোষ্ঠী দেশের অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। যুবারা বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে যেমন সবার আগে সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনি সামনের দিনেও দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ অন্যান্য উদ্ভাবনী অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দেবে। এ যুব জনগোষ্ঠী হবে জাতিসংঘ ঘোষিত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের মূল কারিগর।

বাংলাদেশে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর যুব দিবস ২০২৫ উদযাপন করছে। এর মধ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী স্টল স্থাপন, অতিথি আপ্যায়ন এবং স্মরণিকা প্রকাশ করার মতো বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যুবক ও তারুণ্য নিয়ে বিশ্বের সব স্মরণীয় ও বরণীয় মনীষী ও কবি-সাহিত্যিকের রয়েছে আগ্রহ। তাদের কলমে উঠে এসেছে তারুণ্যের জয়গান—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন রচনায় তারুণ্য, যৌবন এবং জীবন সম্পর্কে মূল্যবান ধারণা পাওয়া যায়। তার লেখায় তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা এবং একই সঙ্গে জীবনের গভীরতা ও জিজ্ঞাসার প্রতিফলন দেখা যায়। রবিঠাকুরের রচনাবলি যুবকদের জন্য অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা প্রদানে আজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার লেখা থেকে যুবসমাজ তাদের জীবন নতুন পথে চালিত করার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও সাহস লাভ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তার ‘জীবনদেবতা’বিষয়ক রচনাগুলোতে তারুণ্যকে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যেখানে মানুষ নতুন কিছু খোঁজে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এ ছাড়া তার বিভিন্ন কবিতা ও গানে তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে ফুল, পাখি এবং প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের ব্যবহার দেখা যায়, যা তারুণ্যের সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার দিকটি তুলে ধরে। ‘জগতের যে অমৃত সেই তো তারুণ্য’—এ উক্তির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তারুণ্যকে জীবনের অমৃত হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা নতুনত্ব ও সম্ভাবনা বয়ে আনে।

‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার লাইন। লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা হয় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংগ্রামে মানুষের মনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যুবক ও যৌবন নিয়ে তার অসংখ্য কবিতা ও রচনায় উল্লেখ করেছেন। অসংখ্য নিবন্ধেও উহা পরিপূর্ণ আলোকপাত করা সম্ভবপর হবে না। আমি এ নিবন্ধ যৎসামান্য মূলভাব উল্লেখ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছি। বিদ্রোহী চেতনা—তিনি যৌবনের মধ্যে বিদ্রোহের মন্ত্র দেখতে পান, যা সমাজের অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে উৎসাহিত করে। সৃজনশীলতা—যৌবনকে তিনি নতুন কিছু সৃষ্টি করার অসীম ক্ষমতা এবং উদ্ভাবনী শক্তির আধার হিসেবে বিবেচনা করেন। শক্তি ও সাহস—যৌবনের মধ্যে অমিত তেজ ও সাহস বিদ্যমান, যা মানুষকে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে উৎসাহিত করে। মানবতাবাদ—যৌবন মানুষকে মানবতাবাদী হতে এবং সবার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে অনুপ্রাণিত করে।

কাজী নজরুল ইসলামের ‘যৌবনের গান’ রচনাটি তারুণ্যের জয়গান এবং অফুরন্ত শক্তি ও সাহসের প্রতিচ্ছবি। এ রচনায় নজরুল যৌবনকে জয়ী চেতনা, বিদ্রোহ ও সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। কারণ, যৌবন হচ্ছে অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার। যৌবন মানুষের জীবনকে করে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। দুর্বার উদ্দীপনা, ক্লান্তিহীন উদ্যম, অপরিসীম ঔদার্য, অফুরন্ত প্রাণচঞ্চলতা ও অটল সাধনার প্রতীক যৌবন মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সংস্কারের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যায় সমাজ-প্রগতি ও নতুন স্বপ্নময় মুক্তজীবনের পথে। আর বিপন্ন মানবতার পাশে সে দাঁড়ায় সেবাব্রতী ভূমিকা নিয়ে। পক্ষান্তরে রক্ষণশীলতা, জড়তা, সংস্কারাচ্ছন্নতা ও পশ্চাৎপদতাময় বার্ধক্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় জীবনের প্রাণবন্ত অগ্রগতির পথে।

বাংলাদেশের যুবসমাজ দেশের উন্নয়নের একটি বড় সম্পদ। সঠিক সহায়তা ও সুযোগ পেলে তারা নতুন উদ্ভাবনা, ব্যবসা এবং সামাজিক পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হতে পারে। তবে, এ সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে তরুণরা যে বাধার সম্মুখীন হয়; যেমন শিক্ষা, কাজের সুযোগ এবং নেতৃত্বের সুযোগ—এসব বিষয় সমাধান করতে হবে। আমাদের যুবকরাই দেশের প্রধান সম্পদ ও ভবিষ্যৎ। তাদের উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকারকে আরও পরিকল্পিত দৃষ্টি দিতে হবে। তবেই আশা করি এ ছাত্র ও যুব জনগোষ্ঠীর হাত ধরেই মাদক, ইভটিজিং, যৌতুক, নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।

লেখক: প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল ও প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাবিতে ছাত্রদলের নেতাদের উদ্দেশ্যে ‘গেট আউট’ স্লোগান

রাষ্ট্রপতির ছবি‌ সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল মৌখিকভাবে

রাষ্ট্রপতির ছবি‌ সরানো প্রসঙ্গে উপপ্রেস সচিবের ব্যাখ্যা

আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে নেপাল গেলেন আমির খসরু

গোলকিপারের ভুলে ইউনাইটেডকে হারাল আর্সেনাল

নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা বিএনপির জনপ্রিয়তাকে ভয় পায় : টুকু

দেশে প্রথম মঞ্চায়িত হচ্ছে গ্রিক নাটক ‘তর্পন বাহকেরা’

দুই ঘণ্টার হাটে বিক্রি হয় কোটি টাকার পান

‘অসাধু জেলেদের কারণে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য’

সশস্ত্র বাহিনীর বঞ্চিত অফিসারদের আবেদন পর্যালোচনায় নতুন উদ্যোগ

১০

সংসদীয় সীমানা নিয়ে ৮৩ আসন থেকে ১৭৬০ আপত্তির আবেদন

১১

গণতন্ত্র নস্যাৎকারীরা আবারো সক্রিয় হচ্ছে : লায়ন ফারুক

১২

খালেদা জিয়ার জন্য সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের দোয়া মাহফিল

১৩

আ.লীগ নেতা লিটনের ভাইসহ তিনজন ৫ দিনের রিমান্ডে 

১৪

ডাকসুতে শিবিরের ভিপি-জিএস প্রার্থী হচ্ছেন যারা

১৫

৩ দাবিতে প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের মানববন্ধন

১৬

রিকশা চালালেও হৃদয়ে শিল্প লালন করেন জাহাঙ্গীর

১৭

বিএনপির সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন জোরদার করার তাগিদ

১৮

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই জব্দ, ৫৫ জনের নামে মামলা

১৯

ফারুকীর অস্ত্রোপচারসহ সার্বিক পরিস্থিতি জানালেন তিশা

২০
X