জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। মহাবিশ্বে অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না, অনেক বিজ্ঞানী এখন আর সে প্রশ্ন করেন না। বরং তাদের প্রশ্ন হচ্ছে—কবে সেই প্রাণের খোঁজ মিলবে? বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ আশাবাদী যে, আমাদের জীবদ্দশায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো দূরের কোনো গ্রহে জীবনের সন্ধান পাওয়া যাবে। বর্তমান বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু যেখানে মাত্র ৭৩ বছর, সেখানে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন ২০৫০ সালের মধ্যেই মানুষের গড় আয়ু পৌঁছাতে পারে হাজার বছর পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় অগ্রগতি মানুষের জীবনধারা বদলে দিচ্ছে। সভ্যতা এগিয়ে গেলেও আমরা এখনো রয়ে গেছি সেই মধ্যযুগে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পৃথিবী আলোকিত হলেও আমরা আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিতে পারিনি। মানুষের মন থেকে দূর করা যায়নি মধ্যযুগীয় অন্ধকার। শনিবার কালবেলায় প্রকাশিত ‘তান্ত্রিক বাবা’র মন্ত্রে সর্বনাশ নারীদের শীর্ষক প্রতিবেদন আমাদের এ বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানে একুশ শতকের এ তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও মানুষ দ্বারস্থ হচ্ছে ‘তান্ত্রিক বাবা’র।
তার নির্দেশে কেমিক্যাল দিয়ে পুড়িয়েছেন হাতের তালু। এরপর ছুটছেন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত মে থেকে জুলাই পর্যন্ত তিন মাসে তাদের মতো অন্তত ৩০ জন নারী এক হাতের তালু পোড়া নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। তারা প্রায় সবাই মধ্যবয়সী গৃহবধূ এবং অবিবাহিত তরুণী। তাদের কারও স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য ছিল, কারও চলছিল পারিবারিক কলহ। কেউ আবার প্রেমিককে ‘বশে’ আনতে পুড়িয়েছেন সুন্দর হাতখানি! তাদের প্রায় অভিন্ন গল্প শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, ‘পোড়া কপালে’ সুখ ফেরাতে তান্ত্রিক বাবার ফাঁদে পা দিয়ে নিজের অঙ্গহানি ঘটিয়েছেন। এমন ঘটনার পর কেউ না পেয়েছেন স্বামীর মন, অবিশ্বাসে কেউ হারিয়েছেন প্রেমিককে। যেন হাতের সঙ্গে পুড়েছে তাদের ভাগ্যের কপালও। সংসারে শান্তি ফেরাতে কিংবা প্রেমের সম্পর্কে পথের কাঁটা দূর করতে তান্ত্রিক বাবার মোহময় কথায় তার হাতে তুলে দিয়েছেন একান্ত ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর ছবি, ভিডিও। সেই ছবি আর ভিডিও দিয়ে জিম্মি করে অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন তান্ত্রিক বাবা, কেউ কেউ হন শ্লীলতাহানির শিকারও।
তান্ত্রিক বাবাদের গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করা যাবে না। এ সংকটের মূলে রয়েছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও মানুষের অজ্ঞতা। সমাজে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এখন ঘরের মধ্যে ঢুকে গেছে। একেবারে ভাই-বোনের মধ্যে বিস্তৃতি হয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও নগরায়ণের কারণে দুর্বল হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী সামাজিক বন্ধন। আগেকার দিনে যৌথ পরিবারে বসবাস করার কারণে মানুষ একে অপরের সঙ্গে বেশি সময় কাটাত, কিন্তু বর্তমানে মানুষ একা থাকতে পছন্দ করে। এখন তাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এসব যোগাযোগ মাধ্যম মানুষকে একে অপরের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত করে, কিন্তু প্রকৃত সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন এবং ঘনিষ্ঠতা তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে একপর্যায়ে দেখা দেয় হতাশা, এরপর অবদমিত বিষণ্নতা। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তোলা। এ জন্য প্রয়োজন আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থান্বেষী স্বভাবের বিপরীতে সহনশীলতা ও সহমর্মিতার বোধ জাগ্রত করা।
মন্তব্য করুন