বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্রে ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য এখন ধীরে ধীরে চ্যালেঞ্জের মুখে। এই চ্যালেঞ্জের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ব্রিকস—একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক জোট।
নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) হলো ব্রিকস জোটের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ২০১৪ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মূল লক্ষ্য হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য শক্তি ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ ২০২১ সালে এনডিবির সদস্য হয় এবং বর্তমানে দেশে একটি শাখা স্থাপনের জন্য ১.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই শাখা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, রেলওয়ে আধুনিকীকরণ, সড়ক যোগাযোগ উন্নয়ন এবং বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে। এ ছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ব্রিকস সম্মেলন আয়োজনের সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ব্রিকসের যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনকে নিয়ে। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্ত হয়। ২০২৪ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, ইথিওপিয়া ও ইরান যুক্ত হলে জোটের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ওজন বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। ২০২৫ সালের কাজান সম্মেলনে ‘পার্টনার কান্ট্রি’ কাঠামোর আওতায় আরও ১৩টি দেশ যুক্ত হয়। বর্তমানে ব্রিকস ও সহযোগী দেশগুলো বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠী এবং পিপিপি ভিত্তিক বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বর্তমানে অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য শক্তি ও প্রযুক্তি খাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের মাধ্যমে সদস্য ও সহযোগী দেশগুলোর উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা করছে। ডলারের ওপর নির্ভরতা হ্রাসে ব্যাংকটি স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ করেছে এবং এ লক্ষ্যে চালু করেছে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ‘ব্রিকস পে’। ২০২৫ সালে চালু হতে যাওয়া একটি বিশেষ গ্যারান্টি ফান্ড বেসরকারি বিনিয়োগ সুরক্ষা ও ঝুঁকি প্রশমনের মাধ্যমে বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণে প্রণোদিত করবে।
ব্রিকসের প্রতিটি সদস্য দেশ নিজস্ব শক্তি দিয়ে জোটকে সমৃদ্ধ করছে—চীন অবকাঠামো ও প্রযুক্তির ইঞ্জিন, রাশিয়া জ্বালানির সম্রাট, ব্রাজিল কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার দুর্গ, ভারত সেবা ও ওষুধ শিল্পের নেতৃত্বে, আর দক্ষিণ আফ্রিকা খনিজ সম্পদের গেটওয়ে। এই সমন্বয় জোটটিকে বহুমুখী শক্তি দিয়েছে।
এর ফলে জোটটির প্রভাবে জ্বালানি আমদানির ব্যয় কমছে, প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় লেনদেনের সময় ঘণ্টা থেকে মিনিটে নেমে এসেছে, কৃষিতে বিকল্প বাজার তৈরি হয়েছে, আর স্বাস্থ্যসেবায় সাশ্রয়ী সমাধান পৌঁছেছে লাখো মানুষের কাছে। তবে চ্যালেঞ্জও আছে—শুল্ক বৈষম্য, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, পশ্চিমা বাজারে প্রবেশের বাধা, ভারত-চীন টানাপোড়েন এবং রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক সংকট জোটের ঐক্যকে নড়বড়ে করতে পারে।
তবুও সম্ভাবনা বিশাল। বিশ্লেষকদের মতে, ২০৪০ সালের মধ্যে ব্রিকস বৈশ্বিক জিডিপির এক-তৃতীয়াংশের বেশি ধারণ করতে পারে। সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হবে নিজস্ব মুদ্রা চালু করা, যা ডলারবিহীন বাণিজ্যের নতুন যুগের সূচনা করবে।
আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী—যদি চীন-ভারতের সীমান্ত টানাপোড়েন কূটনীতির মাধ্যমে প্রশমিত হয়, রাশিয়া জ্বালানি সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে, ব্রাজিল কৃষি নিরাপত্তায় বিনিয়োগ অব্যাহত রাখে, ভারত তার সেবা খাতের ডিজিটাল প্রভাব বাড়ায় এবং দক্ষিণ আফ্রিকা আফ্রিকান খনিজ রপ্তানি চেইন স্থিতিশীল রাখে—তাহলে ব্রিকস কেবল ‘জি৭’-এর বিকল্প নয়; বরং বিশ্ব অর্থনীতির নতুন মেরুকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
এটি হবে এক বহুমেরু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সূচনা, যেখানে ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে যাবে এবং উদীয়মান অর্থনীতিগুলো পাবে সমান কণ্ঠস্বর।
লেখক: দুবাই প্রতিনিধি, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন