ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না—পরস্পরবিরোধী দুই ধরনের বক্তব্যই রাজনীতির মাঠে ভেসে বেড়াচ্ছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূস রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর কয়েকটি রাজনৈতিক দল রীতিমতো বাকযুদ্ধে লিপ্ত। কোনো কোনো শক্তি নির্বাচন আটকে ফেলতে চাচ্ছে। রাজনীতির দৃশ্যপটে দেখা যাচ্ছে নানা ঘটনা। বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর নির্দেশে নতুন করে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। তাহলে কি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে অন্য কাউকে বসানো হচ্ছে? এ নিয়ে চলছে নানা সমীকরণ। মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের লন্ডন-ঢাকা দৌড়ঝাঁপ অনেকের চোখে পড়েছে। এ নিয়েও গুঞ্জনের ডালপালা মিলছে। টিআইবি বলছে, রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। জুলাই সনদ ঘোষণা এখনো ঝুলে আছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ কলকাতায় পার্টি অফিস খুলে গোপনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্বৈরাচারের দোসর তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টি আরেক দফা ভেঙেছে। জেপি সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, ‘সংঘাত অনিবার্য।’ আরেকটি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্প্রতি বলেছেন, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।’ সবকিছু মিলিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে—ডালের মধ্যে কালো কী দেখা যাচ্ছে?
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এরপর নির্বাচন কমিশনের শুরু হয় জোর তৎপরতা। কমিশন বৈঠকের পর বৈঠক করে চলেছে। ইসি হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২’ সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার দিন শেষ। বিনা ভোটে জয় ঠেকাতে একক প্রার্থীর বিপরীতে ‘না’ ভোটের বিধান চালু হচ্ছে। পুরো আসনের নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা পাচ্ছে ইসি। নতুন বিধানে আরও যুক্ত হচ্ছে, জোট হলেও প্রার্থীকে ভোট নিজ দলের প্রতীকে করতে হবে। এ ছাড়া ভোটের মাঠে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো ক্ষমতা দেওয়ার বিধানও থাকবে। নির্বাচন কমিশনের সংশোধিত এসব বিধান আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই শেষে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে আইনে পরিণত করা হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে নির্বাচন। এরই মধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এসব তৎপরতা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, কমিশন নির্বাচনী ট্রেনের যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি ভালোভাবেই নিচ্ছে। ড. ইউনূস মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে প্রবাসীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত।’ প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য সিঙ্গাপুরভিত্তিক টিভি চ্যানেল সিএনএকে বলেছেন, ‘বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে পুরোনো সমস্যা ফিরবে।’
প্রধান উপদেষ্টার সুস্পষ্ট ঘোষণা এবং কমিশনের নানামুখী পদক্ষেপের পরও নির্বাচন নিয়ে সংশয় কাটছে না। বরং রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের অনেকেই নির্বাচনের আকাশে কালো মেঘ দেখছেন। বর্তমান প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি দল এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সভা-সমাবেশ ও সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ধানের শীষে ভোট চাইতে শুরু করেছেন। সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠক করে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন এবং জয়ী হলে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামীর দাবি, আগে জুলাই সনদ, পরে নির্বাচন। আর নির্বাচন হতে হবে পিআর পদ্ধতিতে। এ দাবিতে দলটি মাঠের কর্মসূচিতে নেমেছে। অন্যদিকে এনসিপি নেতারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিপরীতে শর্তের পর শর্ত ঘোষণা করে চলেছেন। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সম্প্রতি তাদের যুব সংগঠনের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে না। কারণ যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়, আমার ভাই রক্ত দিয়েছেন সংস্কারের জন্য, একটি নতুন সংবিধানের জন্য, কবরে গিয়ে তার লাশটা ফেরত দিতে হবে এই সরকারকে।’ এনসিপি নেতারা এতদিন জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কার এবং বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে আগে কথা বললেও ১৬ আগস্ট এক আলোচনা সভায় তারা এ বিষয়টি সামনে নিয়ে এসে বলেছেন, ‘নির্বাচন যখনই হোক সেটা অবশ্যই হতে হবে গণপরিষদ নির্বাচন।’ প্রফেসর ইউনূস শুরু থেকেই বলে আসছেন, ছাত্ররা তার নিয়োগকর্তা। তিনি উপদেষ্টা পরিষদের তিনজন ছাত্র প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করেন। একজন উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে নবগঠিত এনসিপির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। প্রফেসর ইউনূস নিয়োগকর্তাদের রাজনৈতিক দল গঠনে উৎসাহিত করেছেন। এ নিয়োগকর্তারা এবার প্রফেসর ইউনূসকে রীতিমতো কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছেন। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘লন্ডনে সেজদা দিয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। অথচ তার জনগণের কাছে সেজদা দেওয়ার কথা ছিল। এখনো সময় আছে কেবলা পরিবর্তন করার।’ (দৈনিক কালবেলা, ১৭ আগস্ট)। এনসিপি নেতাদের ‘সংস্কার ও বিচার শেষ হওয়ার পরে নির্বাচন’, ‘আগে গণভোট’, ‘নতুন সংবিধানের অধীনে নির্বাচন’ এবং ‘আগে অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে’—প্রধান উপদেষ্টা এসব দাবির কোনটি বিবেচনায় নিয়ে কী পদক্ষেপ নেবেন, তা দেখার বিষয়। অবশ্য তিনি এ ধরনের রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের ক্ষেত্রে মৌন বা নীরব ভূমিকা পালন করে থাকেন। এনসিপি নেতারা ‘প্রয়োজন হলে জনগণকে নিয়ে আবার মাঠে নামার’ ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন, যারা নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায় তারা গণতন্ত্রের শক্তি নয়। ভোটাধিকার প্রয়োগের বিপক্ষে যারাই বক্তব্য দেবে বা কুযুক্তি উত্থাপন করে গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে কণ্টকাকীর্ণ করবে, তাদের বিরুদ্ধে জনগণ রুখে দাঁড়াবে।
এ পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যেই অবশেষে বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কার কী অবস্থান, তা চূড়ান্ত খসড়ায় সংযোজন করা হয়েছে। খসড়াটি শনিবার ৩০টি রাজনৈতিক দল এবং জোটের কাছে পাঠিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। খসড়াটির উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য পাওয়া সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এতে আইনি ভিত্তি থাকার কথাও বলা হয়েছে। জুলাই সনদের খসড়া বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পাওয়ার পর বাস্তবায়নের পথ খুঁজবে ঐকমত্য কমিশন। কোন কোন প্রস্তাব নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নযোগ্য, তা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করার কথা ভাবছে কমিশন।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন গত এক মাসে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি এবং প্রধান বিচারপতি সঙ্গে বৈঠক করেন। গণমাধ্যমের খবর, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আসন্ন নির্বাচন, সংস্কারের রূপরেখা, জুলাই ঘোষণা, আগামী দিনের পরিকল্পনা নিয়ে মতবিনিময় হয়েছে বলে দলগুলোর সূত্র থেকে জানানো হয়। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল, সুপ্রিম কোর্টের এক কর্মকর্তা এমনটি জানিয়েছিলেন। তারপরও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ ছোটাছুটি নিয়ে নানা প্রশ্ন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপের কথা মনে করে বর্তমান রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা কোনো বিশেষ এজেন্ডার ধারাবাহিকতা কি না, এই প্রশ্নও উঠেছে।
ইতিহাস গবেষক ও নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির মনে করেন, নির্বাচন যাতে ফেব্রুয়ারিতে না হয়, এজন্য বহু রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয়। একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে তিনি বলেছেন, ‘এই সরকারকে আরও প্রলম্বিত করে, সরকারের ভেতরে যারা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান, তাদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে।’ ড. ইউনূস ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিয়ে একটা সম্মানজনক বিদায় নেওয়ার জন্য আগ্রহী বলে নুরুল কবিরের ধারণা।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশিদের আশা এক বছরে হতাশায় পরিণত হয়েছে।’ এর মধ্যে এক-এগারোর পদধ্বনির কথা বলা হচ্ছে। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সম্প্রতি ফেসবুক পোস্টে এক-এগারোর কথা বলে পরে তা ডিলিট করে দেন। তবে সম্প্রতি সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মন্তব্য করেছেন, ঐক্য না থাকলে, ছাড় না দিলে আরেকটা এক-এগারো আসবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বছরে না ঘুরতেই স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে কেন বিভাজন তৈরি হলো? কেন মাঝেমধ্যেই ওয়ান-ইলেভেনের পদধ্বনির কথা বলা হচ্ছে? এক-এগারোর পদধ্বনির কথায় রাখাল বালকের সেই ‘বাঘ আসিল, বাঘ আসিল’ গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। গল্পে বাঘের আগমন, পরে রাখাল বালকের পরিণতির কথা আমরা সবাই জানি। স্মরণ করা জরুরি যে, ২০০৭ সালে সংঘটিত ওয়ান-ইলেভেন রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের জন্য মোটেই সুখকর ছিল না, বরং তিক্ততা নিয়ে এসেছিল। প্রধান দুই নেত্রীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। কারাগারে যাওয়ার পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল প্রধান দুই দলের অনেক নেতাকর্মীকে। সেনাসমর্থিত এক-এগারোর ওই সরকারের অধীনে নির্বাচন বিলম্বিত হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল সেনানিয়ন্ত্রিত নির্বাচন।
শুধু নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দেয় না। তবে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার প্রথম ধাপ অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। শেখ হাসিনা পরপর তিনটি প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন। তিনটি নির্বাচনেই ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় জনগণ। এর ফলে জনগণ নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন জরিপে এমন ইঙ্গিতই মিলছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, ভোটারদের নির্বাচনমুখী করাই হবে কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর সুযোগ নেবে নাকি অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হবে—এটিই এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয়।
লেখক: কলাম লেখক
মন্তব্য করুন