যে কোনো দেশের জন্যই কর্মক্ষম মানুষের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকা কিংবা বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা কোনো ইতিবাচক লক্ষণ নয়। বরং তা উদ্বেগের। সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন বলছে, দেশে কর্মে নিয়োজিত বা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে; বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেও এ চিত্র হতাশাব্যঞ্জক।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের হার বেড়ে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ হয়েছে; যা গত বছর ছিল ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২৪ সাল শেষে দেশে কর্মে নিয়োজিত বা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে ছিল ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এদিকে ২০২৪ সাল শেষে দেশের ৫ কোটি ৫০ হাজার মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ৪ কোটি ৭১ লাখ ৭০ হাজার। এ সময়ে কৃষি, সেবা, শিল্পসহ সব খাতে কমেছে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি মোট বেকারের সাড়ে ১৩ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ বেকার উচ্চ মাধ্যমিক পাস। ১৫-২৯ বছরের তরুণদের মধ্যে বেকার সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। মোট বেকারের ৭৬ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। বেকার তরুণদের (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী) প্রায় ২৯ শতাংশের মতো স্নাতক ডিগ্রিধারী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটা দাগে বেকারত্ব তিন ধরনের। যেমন সামঞ্জস্যহীনতাজনিত বেকারত্ব, বাণিজ্য চক্রজনিত ও কাঠামোগত বেকারত্ব। শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি থাকলে সেটিকে সামঞ্জস্যহীন বেকারত্ব বলে। অর্থনীতিতে চাঙাভাব কিংবা মন্দাভাবের কারণেও অনেক সময় বেকারত্ব বাড়ে-কমে। যেমন কভিডের কারণে বেকারের সংখ্যা বেড়েছিল। এটি বাণিজ্য চক্রজনিত বেকারত্ব। আবার প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণেও বেকারত্ব বাড়ে। এ ধরনের বেকারত্বকে কাঠামোগত বেকারত্ব বলে।
বেকারত্বের সমস্যা আমাদের দেশে নতুন নয়। তবে গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের নতুন প্রেক্ষাপটে এ সংখ্যা বেড়েছে। আমরা জানি, দেশে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের কর্মসংস্থানের একটি অন্যতম খাত গার্মেন্টস সেক্টর। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশে বন্ধ হয়ে গেছে শত শত শিল্প-কারখানা। এ সংখ্যা দুই থেকে তিন শতাধিক। বিবিএসেরই একটি প্রতিবেদনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে প্রায় ২১ লাখ লোক চাকরি হারানোর খবর উঠে আসে। কারখানা বন্ধের ফলে কাজ হারিয়ে বেকার হয় বিপুলসংখ্যক মানুষ। শুধু ইউএসএইডের ফান্ড স্থগিত হওয়ার কারণেই দেশে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কর্মহীন হয়। এ ছাড়া অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশ একটি অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ তো রয়েছেই, দেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়েছে একরকমের স্থবিরতা। সবকিছু মিলিয়ে অভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি যেমন নতুন করে বেকারত্ব বৃদ্ধির একটি কারণ; ঠিক তেমনি বছরের পর বছর ধরে দেশে কাজের চাহিদা ও জোগান, নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মধ্যকার অসামঞ্জস্যও বৃহদাংশে দায়ী।
আমরা মনে করি, বেকারত্ব কমাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ভূমিকা দরকার সব ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। একই সঙ্গে অত্যাবশ্যক অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা। বিদেশি বিনিয়োগকে আকর্ষণ করতে যার অন্যথা নেই। আমাদের মতো দেশে যেহেতু সামাজিক সুরক্ষা বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কর্মহীনদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা বা ভাতার ব্যবস্থা নেই, তাই বেকারত্বর মানে দাঁড়ায় এক কথায় ‘অভিশাপ’। এর ফলে সমাজে বাড়ে নানা অপকর্ম, অপরাধ ও অন্যায়।
মন্তব্য করুন