ঢাকার মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মর্মান্তিক এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন মারা গেছেন। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন আরও কয়েকজন। কালবেলা পরিবারের পক্ষ থেকে নিহতের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবার ও স্বজনদের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।
রাজধানীর রূপনগরের আবাসিক এলাকার ৩ নম্বর সড়কের একটি দোতলা ভবনে গোপনে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘এম এস আলম ট্রেডিং’ নামে রাসায়নিকের গুদাম। মঙ্গলবার সেখান থেকে সৃষ্ট আগুন পাশের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ছড়িয়ে এ ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ ওই ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষ বলছে, রাসায়নিকের গুদামটি ছিল অবৈধ। সেটি উচ্ছেদের জন্য তিনবার নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই নোটিশ যে পাত্তা পায়নি এবং এর বিরুদ্ধে কেউ আর ব্যবস্থাও নেয়নি। বলা বাহুল্য, অতীতের মতোই প্রতিবার এক একটা ট্র্যাজেডি ঘটে, এরপর জানা যায় যে, তা ছিল অবৈধ! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুদামটিতে প্রাণঘাতী রাসায়নিকের মজুত ছিল। জানা যায়, রূপনগর ও আশপাশের এলাকায় কেমিক্যাল গুদামের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শিয়ালবাড়ি এলাকায় রাস্তার পাশে অনেক ভবনের নিচতলা ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে কেমিক্যাল, পেইন্ট, প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকান ও গুদাম হিসেবে। এসব গুদামে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। নেই ফায়ার সেফটি, বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, এমনকি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রাণঘাতী এসব অবৈধ কেমিক্যালের কারবার, তা দেখভাল বা নজরদারির দায়িত্ব কার? সন্দেহ নেই দায়িত্ব যার বা যে প্রতিষ্ঠানেরই থাক না কেন, কাজটি যে ঠিকঠাক হয় না, তার বড় প্রমাণ হচ্ছে, কিছুদিন পরপর একটি করে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আর তাতে মানুষের মৃত্যু। আমরা অতীতে বারবার একইরকম ট্র্যাজেডির শিকার হয়েছি। এর আগে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলী ও ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কথা সবারই জানা। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর সুস্পষ্ট সুপারিশ ছিল। কিন্তু রাসায়নিক দ্রব্য পরিবহন ও গুদামজাতকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যুগোপযোগী আইন এবং সমন্বিত কোনো বিধিমালা আজও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। দেখা যায়নি বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সংস্থা দেখভালের দায়িত্বে থাকায় শেষ পর্যন্ত কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ। অনুমান করা কঠিন নয় যে, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি বড় রকমের বাধা হিসেবে কাজ করে।
আমরা জানি, অতীতে রাজধানী ঢাকার বেশ কিছু এলাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। মিরপুরও ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদামের তালিকায় ছিল। কিন্তু উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। ফলে এটা ধারণা কঠিন কিছু নয় যে, এমনভাবে চলতে থাকলে এমন ট্র্যাজেডি বারবার ঘটবে। আমরা মনে করি, এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য কারখানা ও গুদামের মালিক, কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ ও সংস্থার কেউই দায় এড়াতে পারে না। আমাদের প্রত্যাশা, অবৈধ কেমিক্যাল মজুত উচ্ছেদ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে; আইনের আওতায় আনা হবে মজুতদারদের। এ ছাড়া ভবিষ্যতে এমন ট্র্যাজেডির মুখোমুখি যেন না হতে হয়, সে ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি সুপরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন