ইদানীংকালের সবচেয়ে হিট কথাটি হলো সেফ এক্সিট। কথাটা শুনে কারও বাড়ে হার্টবিট। কারও চোখ করে পিটপিট। কেউবা হাসে মিটমিট। কেউ ভাবে নতুন কোনো চিট (বাটপার)। কেউ আবার কনফিউজড লিটল বিট। কেউ ভাবছে কবে খুলবে এই গিঁট। তবে যে যাই ভাবুক না কেন, কথাটা কিন্তু কাঁপিয়ে দিয়েছে কারও কারও ভিট।
পৃথিবীর বুকে একটি পরিচিত শব্দ ফায়ার এক্সিট। বড় দালানকোঠা, কলকারখানা বা বিপণিবিতানে আগুন লাগলে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পথ বা সিঁড়ি থাকে। নানা প্রকার সংকেত, ব্যানার বা ছোট ছোট সাইনবোর্ডে ওই নিরাপদ পথ ধরে বের হওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া থাকে। তবে বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা বেশি। সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে যাওয়াটাই অর্থনীতির সূত্র। সে কারণেই হয়তো বেশি মানুষের বাংলাদেশে সবকিছুর দাম বেশি হলেও মানুষের জীবনের দামটাই কম। তাই আগুন লাগলে মানুষ কোন পথে বের হবে বা ফায়ার এক্সিট কোথায়, তা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। সম্প্রতি পুরান ঢাকার কোর্ট-কাচারিখ্যাত আদালত ভবনের পেছনে আইনজীবী সমিতির একটি বহুতল ভবনে যেতে হয়েছিল। কয়েকশ আইনজীবীর চেম্বার এ ভবনে। অথচ ভবনে ঢোকার ও বের হওয়ার রাস্তা, বিশেষত চেম্বারের দুই সারির মাঝে চলাচলের পথটুকু এতটাই সরু যে, উকিল আর মক্কেলের পাশাপাশি হাঁটাও মুশকিল। আইনজীবীদের এ ভবন-ও ভবনের নকশা যদি আইনের দৃষ্টিতে ও ফায়ার ব্রিগেডের পরিদর্শনে আইনসিদ্ধ হয়, তবে দেশে বেআইনি বলতে আর কোনো ভবন বা ভবন নকশা হয়তো নেই।
মানুষ বেশি হওয়া নিয়ে একটা গল্প বলি। আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড এবং বাংলাদেশের তিন বন্ধু গল্প করছিল একটি নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজে দাঁড়িয়ে। নিজ দেশের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ নিয়ে গল্প পরিণত হলো তর্ক-বিতর্কে। সুইজারল্যান্ডের বন্ধু নিজের হাতঘড়ি নদীতে ফেলে ঘোষণা দিল—এমন ঘড়ি আমাদের দেশে এত বেশি যে, যখন-তখন আমরা এমন ঘড়ি ফেলে দিতে পারি। আমেরিকার বন্ধু হাতে থাকা আইফোন ফেলে দিয়ে বলল—আমাদের দেশে এমন ফোন এত বেশি যে, দিনে এমন দু-চারটা ফোন ফেলে দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। এবার বাংলাদেশি বন্ধু সুইজারল্যান্ডের বন্ধুকেই নদীতে ফেলে দিয়ে বলল—আমাদের দেশে মানুষ এত বেশি যে, এমন ২০০-৫০০ মানুষ নদীতে ফেলে দেওয়াকে আমরা গোনায় ধরি না। এ দৃশ্য দেখে আমেরিকার বন্ধু দিল ভোঁ-দৌড়। বাংলাদেশি বন্ধু প্রশ্ন করল—কই যাও বন্ধু? আমেরিকার বন্ধু উত্তর দিল—সেফ এক্সিট।
ইদানীং দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে সেফ এক্সিট নিয়ে। এই সেফ এক্সিটের সঙ্গে সত্যিকারের আগুনের সম্পর্ক না থাকলেও রাজনৈতিক আগুন বা ক্ষমতার উত্তাপের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দেশের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যখন বিক্ষুব্ধ জনতা জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু করে, তখন ক্ষমতাসীনরা জনগণ, গণমাধ্যম ও বিদেশিদের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নিজেরাই মেট্রো স্টেশন, টিভি সেন্টার, দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মতো সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়। তারপর আন্দোলনের আগুন ও উত্তাপ না কমলে জলকামানে পানি বা ‘গরম জল’ ছিটানো হয়। তারপরও কি আগুন নেভে? নেভে না। বরং তা রুনা লায়লার মতো গান গায়—‘মনে মনে যৌবনে লাগল আগুন, জল দিলে নিভে না জলে যে দ্বিগুণ’। আর এ আগুন দ্বিগুণ হলে ‘... পালায় না’ বলা মানুষগুলোও হেলিকপ্টার, বিমান কিংবা নৌকায় পালিয়ে যায়, যার রাজনৈতিক নাম ‘সেফ এক্সিট’।
ইতিহাসের পাতায় সেফ এক্সিটের বহু উদাহরণ আছে। আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০৯ সন) বর্তমান ইসরায়েল ভূখণ্ডে অবস্থিত ছিল জুদাহ রাজ্য। সেই জুদাহ রাজ্যের রাজা জিহোয়াহাজ ক্ষমতায় টিকতে না পেরে মরুপথে মিশরে সেফ এক্সিট করেন এবং সেখানকার কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনার প্রায় ১৮০০ বছর পর তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি তৎকালীন গৌড় রাজ্য আক্রমণ করেন। এ সময় গৌড় ও বাংলার রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন। বখতিয়ার খিলজি মাত্র ১৭ জনকে সঙ্গে নিয়ে নদীয়ার রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করেন। এ সময় রাজা লক্ষ্মণ সেন দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিলেন। হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা লক্ষ্মণ সেন অবস্থা বেগতিক দেখে খালি পায়ে পেছনের দরজা দিয়ে সেফ এক্সিট নেন বাংলার বিক্রমপুরে। তারও প্রায় ৫০০ বছর পর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিপাহসালারের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। জীবন বাঁচাতে নৌকাযোগে সেফ এক্সিটে বের হন নবাব ও তার পরিবার। এবার মাঝির বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়েন নবাব। ধারণা করা হয়, খালি পায়ে হাঁটতে পারতেন না নবাব। তাই সাধারণ পোশাক পরা নবাবকে কেউ চিনতে না পারলেও মাঝি রাজকীয় জুতা দেখে ঠিকই চিনে ফেলেন নবাবকে। বছরখানেক আগে আবার নৌকাযোগে এক বুজুর্গ তার একজন সঙ্গী নিয়ে সেফ এক্সিটে যাওয়ার সময় বুড়িগঙ্গায় ধরা পড়েন। তিনি দামি জুতার বদলে স্যান্ডেল আর সফেদ পোশাকের বদলে রঙিন লুঙ্গি পরেছিলেন। এমনকি তার চিরচেনা সফেদ দাড়ি ফেলে ক্লিন শেভ অবস্থায় নৌকায় উঠেছিলেন। এমন পরিবর্তনের কারণে কেউ তাকে না চিনলেও তার সঙ্গীকে চিনে ফেলে সবাই। বলা হয় যে, সঙ্গীকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় তার মধ্যে হঠাৎ বাঙালির স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য বা বাঁশ দেওয়ার চেতনা জেগে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন শুধু আমাকে কেন? তাকে (বুজুর্গকে) নিচ্ছেন না কেন? তাকে চেনেননি? তিনি তো বিখ্যাত সেই বুজুর্গ, যার নিয়ন্ত্রণে ছিল শেয়ারবাজারসহ বহু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যস, আর যায় কোথায়? বুজুর্গ কট খেলেন। সেফ এক্সিটের উদ্দেশ্যে বের হওয়া বুজুর্গ ও তার সঙ্গীকে নৌকা ছেড়ে কারাগারে যেতে হলো। আরেক সাবেক ও বিতর্কিত বিচারক বন-জঙ্গল দিয়ে সেফ এক্সিটে যাওয়ার সময় প্রতারিত হন স্থানীয় দালাল ও বাটপারদের হাতে। প্রতারকচক্র তার সঙ্গে থাকা দামি সবকিছু নিয়ে যায়। অসহায় ও অসুস্থ অবস্থায় তাকে মাটিতে কলাপাতা বিছিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে স্থানীয় জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সীমান্ত থেকে তার সেফ এক্সিট হয় কারাগারে। কলাপাতার বদলে এখন তিনি কম্বল বিছিয়ে ঘুমান।
১৯৯০ সালের ২ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাত থেকে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নির্দেশে সে দেশের সেনাবাহিনী কুয়েত আক্রমণ করে এবং পরদিন শুক্রবার দেশটি দখল করে। এ নিয়ে একটা কৌতুক আছে। কুয়েতের সৈন্যরা ওইদিন শুক্রবার ছুটির দিন ছিল বিধায় কোনো ধরনের যুদ্ধ না করে নিজ দেশ ছেড়ে পাশের দেশ সৌদি আরবে সেফ এক্সিট নেয়। নিজের দেশ দখল নিয়ে তাদের কোনো কষ্ট বা দুঃখ ছিল না। দুঃখ ছিল একটাই—ছুটির দিনে কেন আক্রমণ করল ইরাকিরা?
শুধু সেনাবাহিনী নয়, সেফ এক্সিটের গল্প আছে পুলিশকে ঘিরেও। সারা দিন ডিউটি করে একদিন এক পুলিশ সদস্য বাসায় ঘুমাচ্ছিলেন। মাঝরাতে পাশের ঘরে চোর ঢুকেছে বুঝতে পেরে তার স্ত্রী ঘুমন্ত স্বামীর গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বললেন—‘ওঠো, ওঠো, পাশের ঘরে চোর ঢুকেছে।’ এতে মহা বিরক্ত হলেন পুলিশ মহাশয়। স্বভাবসিদ্ধ হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে উত্তর দিলেন—‘সারা দিন চোর-ডাকাত দাবড়িয়েছি। এখন আমার অফ টাইম। কোনো অবস্থায় ডিউটি করতে পারব না।’ পুলিশের কথা শুনে স্ত্রী লাঠি নিয়ে এগিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। কিন্তু ততক্ষণে সেফ এক্সিটে চলে যায় চোর।
আরেকটা গল্প আছে এক গোয়েন্দাকে নিয়ে। শহরে আসা একদল সন্ত্রাসীর আস্তানা নজরে রাখছিল সাদা পোশাকে এক গোয়েন্দা। সারা সপ্তাহ নজরদারি করে শুক্রবার ছুটির দিনে তাকে দেখা গেল ইউনিফর্ম পরে ঘুরে বেড়াতে। সন্ত্রাসীরা তাকে দেখামাত্র সেফ এক্সিটে চলে গেল। সব জানাজানি হওয়ার পর হেড অফিস থেকে তাকে ইউনিফর্ম পরার কারণ জিজ্ঞেস করা হলো। তার উত্তর ছিল— ‘সপ্তাহজুড়ে আমার সাদা পোশাকে নজরদারি ডিউটি করার কথা। আমি তা করেছি। তাই বলে শুক্রবার ছুটির দিনেও সাদা পোশাক পরব কেন?’
এবার আসি আবহাওয়া প্রসঙ্গে। বড় বিচিত্র এ দেশের মানুষ। সবচেয়ে বিচিত্র এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক আচরণ। রাজনীতিতে ধাক্কা দিয়ে অন্যপক্ষকে ফেলে দেওয়ার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। আবার সুযোগমতো পদ্মা সেতু থেকে টুস করে ফেলে দেওয়ার কথাও শোনা যায়। কিন্তু প্রথমে মাথায় তুলে তারপর ফেলে দেওয়ার অভিনব প্রবণতা বাংলাদেশের মতো অন্য কোথাও নেই। ঠিক তেমনি অভিনব এখনকার আবহাওয়া। এসি চালালে শীতকাল। ফ্যান চালালে বসন্তকাল। কোনো কিছু না চালালে গরমকাল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে বর্ষাকাল। অথচ গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ শেষের হেমন্ত আসন্ন। কিন্তু চিরাচরিত শীতের আগমন বার্তা নেই। এদিকে হঠাৎ হঠাৎ গরম যেন ঢুকে পড়তে চাচ্ছে এই জনপদে। কেউ কেউ বলছেন, এ বছর বর্ষা সেফ এক্সিট পাচ্ছে না বলে এই অবস্থা।
আবার কেউ কেউ বলছেন, ধাক্কা দিয়ে গ্রীষ্ম বা গরমকে বিদায় করা হয়েছে। অথচ যে কোনো সময় চুপ করে ঢুকে পড়তে চায় গরম। শীত শুধু আসছি আসছি বলে দিন গুনছে। কিন্তু বর্ষা একবার বলে—যাব, আবার বলে—জনগণ যদি রাখতে চায়, কীভাবে যাই? প্রিয় পাঠক, এ দেশের একটি দলকে যদি গ্রীষ্ম বা গরম এবং অন্য দলকে শীত তদুপরি মৌসুমি শক্তি বা তৃতীয়পক্ষকে যদি জেঁকে বসা বর্ষা বিবেচনা করা হয়, তবে কেমন হয়?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক
বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন