

আজকের তরুণ প্রজন্মকে আমরা প্রায়ই বলি—যান্ত্রিক, অনুভূতিহীন, পর্দায় বন্দি এক প্রজন্ম। মনে হয়, তারা হারিয়ে ফেলেছে জীবনের উষ্ণতা, মানবিকতার কোমলতা। আমরা তাদের দেখি এক ধরনের ধারণাগত দৃষ্টিতে। আমরা খুঁজি তাদের ভুলগুলো, খুঁজি তাদের ব্যর্থতা; কিন্তু খুব কমই খুঁজি তাদের গুণ, সম্ভাবনা ও আলোকিত দিকগুলো। আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি তাদের অপূর্ণতা খুঁজে বের করতে, উৎকর্ষ নয়—তাদের ভুল দেখি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, কিন্তু তাদের প্রতিভা দেখতে পারি না অন্তরের গভীর চোখে। কিন্তু একটু থেমে, একটু গভীর চোখে তাকালে দেখা যায়—এই তথাকথিত ‘রোবোটিক’ তরুণরাই আসলে নতুন যুগের নির্মাতা, এক সম্ভাবনাময় আলোর কারিগর। প্রযুক্তির নীল আলোর আড়ালে তাদের বুকে জ্বলে সহানুভূতির এক দীপ্ত শিখা, যা বদলে দিতে পারে সমাজের ভাবনা, জাতির দিশা আর আগামী পৃথিবীর পথচলা। এ প্রজন্মের চোখ শুধু নিজের আয়নায় সীমাবদ্ধ নয়; তারা পৃথিবীর যন্ত্রণাও অনুভব করে। আফ্রিকার ক্ষুধার্ত শিশু, গাজার নিঃশব্দ কান্না, কিংবা জলবায়ু বিপর্যয়ে ভেঙে পড়া আমাজনের বন—সবই তাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। তারা টাইপ করে কথা বলে, কিন্তু সেই কথার মধ্যে থাকে মানবতার উষ্ণ স্পর্শ।
গ্রেটা থুনবার্গ—কিশোরী মেয়েটি শুধু জলবায়ু আন্দোলনের প্রতীক নন, মানবতারও এক সাহসী কণ্ঠ। গাজার বিধ্বস্ত শিশুদের পাশে দাঁড়াতে তার মানবিক অভিযাত্রা পৃথিবীকে মনে করিয়ে দেয়—সহানুভূতি এখনো বেঁচে আছে, মানবতা এখনো নিভে যায়নি। সেই কিশোরী কণ্ঠ যখন বিশ্বনেতাদের বিবেক নাড়িয়ে দেয়, তখন আমরা বুঝতে পারি—এ প্রজন্ম নীরব নয়, তারা পৃথিবীর পক্ষেই তাদের উচ্চকিত কণ্ঠ।
তাদের মন উদ্ভাবনী চেতনায় সমৃদ্ধ। চ্যালেঞ্জকে তারা ভয় পায় না, বরং তাতে তৈরি করে নতুন পথ। করোনা মহামারির কঠিন দিনে তারা যেমন অনলাইনে শিক্ষাকে টিকিয়ে রেখেছিল, তেমনি তারা প্রমাণ করেছে—সংকট তাদের থামাতে পারে না। বরং প্রতিটি সংকট তাদের করে তোলে আরও সৃজনশীল, আরও অভিযোজনক্ষম। এ প্রজন্মের জ্ঞানপিপাসা সীমাহীন। তারা বইয়ের পাতায় নয়, বিশ্বের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে থাকা জ্ঞানের নদী থেকে পান করে। তারা প্রশ্ন করতে জানে, সত্য যাচাই করতে জানে। অন্ধ অনুসরণের বদলে তারা যুক্তির আলোয় দেখতে চায়।
তরুণরা আজ শুধু প্রযুক্তির ব্যবহারকারী নয়, পরিবর্তনের স্থপতিও বটে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক রূপান্তর—যেখানে তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাস্তায় নেমে ন্যায়, সত্য ও গণতন্ত্রের পক্ষে এক সাহসী ভূমিকা রেখেছে—তা প্রমাণ করে, এ প্রজন্ম আর নীরব দর্শক নয়, সক্রিয় পরিবর্তন-স্রষ্টা। একইভাবে নেপালের তরুণরাও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে এক নতুন আন্দোলনের জোয়ার তুলেছে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও—চিলি, হংকং, ফ্রান্স কিংবা ইরান—তরুণরাই নেতৃত্ব দিয়েছে ন্যায়বিচার, পরিবেশ ও মানবাধিকারের দাবিতে আন্দোলনকে। চিলিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা শুরু করেছিল মেট্রো ভাড়াবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা পরবর্তী সময়ে পরিণত হয় একটি বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়বিচারের আন্দোলনে। হংকংয়ে তরুণরা নেতৃত্ব দেয় প্রো-ডেমোক্রেসি আন্দোলনে, যেখানে তারা গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রাস্তায় নামে। ফ্রান্সে ‘Yellow Vest Movement’-এও তরুণরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিল—তারা অর্থনৈতিক বৈষম্য ও জলবায়ু নীতির ভারসাম্যহীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ইরানে তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত নারী ও শিক্ষার্থীরা, ‘Woman, Life, Freedom’ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেয়, যেখানে তারা মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের দাবিতে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবাদ করে। তরুণরা প্রমাণ করেছে, নতুন প্রজন্ম নীরব নয়—তারা শোনে, ভাবে এবং প্রয়োজনে ইতিহাসের স্রোতের দিক বদলে দেয়।
তরুণরা আজ পরিবেশবান্ধব, পৃথিবীর প্রতি দায়বদ্ধ। তারা জানে, ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। তাই কেউ বৃক্ষরোপণ করে, কেউ প্লাস্টিক বর্জনের আন্দোলনে নামে, কেউ আবার অনলাইন ক্যাম্পেইনে বিশ্বকে নাড়া দেয়। তাদের স্বপ্ন শুধু চাকরির নয়, এক সবুজ পৃথিবীর। তাদের আবেগ প্রকাশের ধরন ভিন্ন—তারা আঁকে, গান লেখে, ভিডিও বানায়, কিংবা আবার কেউ একখানি ছোট্ট ব্যঙ্গচিত্রের ফ্রেমেই বলে ফেলে তীব্র সত্য। এ ভাষা নিঃশব্দ হলেও গভীর। তারা হাসে ডিজিটাল স্ক্রিনে, কিন্তু কাঁদে মানুষের জন্যই।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা সহনশীল। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ কিংবা ভাষার বিভাজন তাদের কাছে অচল। তারা বিশ্বাস করে, মানবতাই সর্বোচ্চ পরিচয়। একবিংশ শতাব্দীর এ তরুণরা তাই বিশ্বের নতুন নাগরিক—যারা ভেদ নয়, ঐক্যের গান গায়।
আমাদের দায়িত্ব তাদের দোষ খোঁজা নয়, বরং তাদের সম্ভাবনাকে সঠিক পথে চালিত করা। তাদের মাঝে যদি উদাসীনতার মেঘও থাকে, আমরা হতে পারি তাদের দিকনির্দেশনার আলো। কারণ, ফুলের ঘ্রাণ পেতে হলে বাগানকে পরিচর্যা করতে হয়। তেমনি, তরুণ মনকে বিকশিত করতে হলে দিতে হবে ভালোবাসা, সুযোগ ও সুষ্ঠু পরিবেশ। আজকের তরুণ প্রজন্ম আমাদের ভবিষ্যৎ নয়, আমাদের বর্তমানেরই প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। শুধু তাদের হাতে তুলে দিতে হবে দায়িত্বের প্রদীপ আর বলতে হবে—‘তোমাদের হাতেই আগামীর পৃথিবী। সাহস রাখো, এগিয়ে চলো, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।’
তরুণদের নীরবতায় আছে পরিকল্পনা, তাদের নির্লিপ্ততায়ও আছে পথচলার দিশা। আমরা যদি পথ দেখাই, তারা আলোকিত করবে দিগন্ত—কারণ, আগামী সূর্য উঠবে তাদের হাত ধরে।
লেখক: বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর
অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন
মন্তব্য করুন