

ঢাকা শহরকে আমরা প্রায়ই ‘অপরিকল্পিত নগরায়ণ’ বলতে শুনি। বাস্তবে অতিঘনবসতিপূর্ণ এ শহর বিশেষ করে কিছু এলাকার বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় দুর্যোগের সময় এরা নিজেরাই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে!
অসংখ্য ভবন যেন একে অপরের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খোলা জায়গা বলতে কিছুই নেই। না কোনো পার্ক, না খেলার মাঠ, না জরুরি পরিস্থিতিতে আশ্রয় নেওয়ার মতো একটি সামান্য ফাঁকা স্থান। প্রশ্ন জাগে, এ শহর কি সত্যিকার অর্থে পরিকল্পিত? নাকি এটি শুধু কাগজে-কলমে পরিকল্পনার আড়ালে নির্মিত গভীর ঝুঁকির শহর?
আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জানি, আমাদের দেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নগর পরিকল্পনার জন্য একাধিক আইন, বিধি ও নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে। Disaster Management Act 2012, National Building Code, RAJUK-এর বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা, পরিবেশ সুরক্ষা আইন—সবই শহরকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করার জন্য তৈরি। কিন্তু বাস্তবে সমস্যার শুরু এখানেই। দেশে আইন আছে, নীতি আছে, কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ নেই বা খুবই দুর্বল। ফলে উন্নয়ন ঘটে ভবনের সংখ্যায়, কিন্তু নষ্ট হয় নিরাপত্তা ও বাসযোগ্যতার মান।
ঢাকা কি সত্যিই প্রস্তুত?
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ঢাকা একটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হলে এ শহর নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও আশঙ্কা তৈরি হয়—রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে, ভবন ভেঙে পড়বে, গ্যাস বিস্ফোরণ হবে, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হবে, চিকিৎসা ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা—রেসকিউ টিমের ঢোকার পথই প্রায় থাকবে না। সংকীর্ণ গলি, অবৈধ স্থাপনা, অগোছালো নির্মাণ এবং খোলা জায়গার অভাবে উদ্ধারকাজ হবে ধীরগতির, অকার্যকর এবং বহু মানুষের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠবে।
এ পরিস্থিতির কারণ কী?
ঢাকার অধিকাংশ ভবনই নির্মিত হয়েছে জাতীয় বিল্ডিং কোড না মেনে। অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যত নিয়ন্ত্রণই থাকুক, সেগুলোর কার্যকারিতা সীমিত। অনেক ভবনের কাঠামোই ভূমিকম্প সহনক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল। ঢাকায় মাথাপিছু খোলা জায়গা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের তুলনায় বহুগুণ কম। দ্রুত নগরায়ণের চাপে মাঠ, পার্ক, জলাধার, ফাঁকা জমি—সবই দখলে গেছে। ফলে বিপর্যয়ের সময় মানুষ কোথায় একত্রিত হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। এ ছাড়া অনেক এলাকায় ভবনগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না। জরুরি লেন তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। পাশাপাশি নগরবাসীর একটি বড় অংশই জানে না ভূমিকম্পের মুহূর্তে কী করতে হবে। স্কুল-কলেজে নিয়মিত ড্রিল নেই, সরকারি-বেসরকারি অফিসেও নেই। প্রস্তুতির অভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, দুর্ঘটনা বাড়ে। রয়েছে আইনের বাস্তব প্রয়োগে দুর্বলতা।
সমাধান কোথায়? শহরকে কি বাঁচানো সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব, যদি আমরা এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নিই এবং তা বাস্তবায়নে কঠোর ও আন্তরিক হই। ঝুঁকিতে থাকা এ নগরীর বাসিন্দা হিসেবে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে আমরা কি এমন একটি শহর চাই, যেখানে একটি ভূমিকম্প মুহূর্তেই হাজারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারে? নাকি আমরা এমন একটি শহর চাই, যেখানে উন্নয়ন হবে নিরাপত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে? নিরাপদ ঢাকা গড়ার দায়িত্ব আমাদেরই।
রানা সরকার, শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি
মন্তব্য করুন