

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এ নিবন্ধটি লিখছি। একসময় একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যার নেতৃত্বে রাজপথে লড়াইয়ে শামিল হয়েছি, পরবর্তীকাল দীর্ঘ পাঁচ বছর যার সান্নিধ্যে থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছি, তিনি আজ মুমূর্ষু অবস্থায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার স্বাস্থ্যের এ আকস্মিক অবনতি গোটা জাতিকে বিষণ্ন-বিমর্ষ করে ফেলেছে। সবার মনেই উৎকণ্ঠা—সুস্থ হবেন তো খালেদা জিয়া? আবার তিনি রাজনীতির মাঠে স্বমহিমায় দেদীপ্যমান হয়ে আলো ছড়াবেন তো? এসব প্রশ্নের জবাব কারও কাছে আছে বলে মনে হয় না। অথচ প্রশ্নগুলো অবান্তর নয়। বরং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসব প্রশ্নের গুরুত্ব শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা, দেশের এই রাজনৈতিক অভিভাবকহীন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার মতো প্রাজ্ঞ, স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন ও দৃঢ় নেতৃত্বের বিকল্প নেই।
গত শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) তার চিকিৎসকরা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন সাংবাদিকদের জানালেন, ‘ম্যাডামের অবস্থা সংকটাপন্ন’, উদ্বেগাকুল হয়ে উঠল বাংলাদেশ। নেমে এলো ভয়ংকর নিস্তব্ধতা। উৎকণ্ঠিত প্রত্যেক মানুষ ফোন করে পরিচিতজনের কাছে জানতে চেয়েছেন, কেমন আছেন দেশনেত্রী? আমার কাছেও এসেছে অনেক ফোনকল। তার সাবেক কর্মী হিসেবে সবাই জানতে চেয়েছেন, কেমন আছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী? স্পষ্ট কোনো জবাব দিতে পারিনি। বলেছি, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। তার দয়ার ওপর ভরসা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। আমরা শুধু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রার্থনা করতে পারি, তার সুস্থতার জন্য।
বেগম জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতির খবরে দেশব্যাপী যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে, তা নজিরবিহীন। সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ তার সুস্থতা কামনা করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। বলা যায়, মানুষের দোয়ায় ভাসছেন বেগম জিয়া। এমনিতে তার জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন কোনোকালেই ছিল না, এখনো নেই। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনি। আমার পরিচিত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে, কেউ মন্তব্য করে খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা করেছেন, করে চলেছেন। দলমত নির্বিশেষে তারা বলছেন, এ মুহূর্তে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সুস্থ খালেদা জিয়াকে বড় প্রয়োজন। তিনি আমাদের জাতীয় মুরব্বি, অন্ধকার রাতে গভীর সমুদ্রে চলমান নৌযানের সঠিক পথনির্দেশক ‘বাতিঘর’।
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হওয়ার সংবাদে সারা দেশে জনগণের মধ্যে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেক রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজনৈতিক নেতার ভাগ্যেই হয় না। মনে পড়ে ১৯৯৯ সালে জর্ডানের বাদশাহ হোসেন যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন, তখন সে দেশের হাজার হাজার নারী-পুরুষ সমবেত হয়েছিলেন হাসপাতালের গেটে। চিকিৎসকদের প্রতি তাদের দাবি ছিল, বাদশাহকে বাঁচাতে কী লাগবে? রক্ত, লিভার, কিডনি, হার্ট বা অন্য কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ? যা দরকার তোমরা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নাও। তবু আমাদের বাদশাহকে সুস্থ করে তোলো। সে সংবাদ তখন বিশ্ব মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেছিল। আজ যদি বলা হতো—খালেদা জিয়াকে সুস্থ করতে হৃৎপিণ্ড লাগবে, কিডনি লাগবে, লিভার লাগবে, আমার বিশ্বাস, লাখো লাখো মানুষ সমস্বরে বলত—আমারটা নাও, তবু আমাদের আপনজন এই মহীয়সী নেত্রীকে বাঁচিয়ে তোলো। কিন্তু খালেদা জিয়ার অবস্থা এখন আর সে পর্যায়ে নেই। তার চিকিৎসা চলছে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে। গত শনিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছেন। সবশেষে তিনি বলেছেন, চিকিৎসকরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। কিন্তু সুস্থ করার মালিক আল্লাহ। তিনি জানালেন, ম্যাডামের স্বাস্থ্যের একটু উন্নতি হলেই তাকে বিদেশে নেওয়া হবে। উদ্বিগ্ন দেশবাসীর এখন ধৈর্য ধারণ ও মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। গতকালের সব দৈনিক পত্রিকায় খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খবর অত্যন্ত গুরুত্বসহ প্রকাশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, আগের চব্বিশ ঘণ্টায় তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়নি, তবে উন্নতিও হয়নি। স্থিতিশীল আছে। এ খবর দেশবাসীকে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করেছে। তারা আশায় বুক বেঁধেছেন, আল্লাহর অপার করুণায় প্রিয় নেত্রী হয়তো সুস্থ হয়ে আবার তার প্রিয় দেশবাসীর কাছে ফিরে আসবেন।
হাসপাতালে মুমূর্ষু খালেদা জিয়ার প্রতি দেশবাসীর যে সহানুভূতি, এতে কোনো কৃত্রিমতা নেই। এই অকৃত্রিম ভালোবাসা তিনি অর্জন করেছেন। পৃথিবীতে রাজ্য জয় করার চেয়ে মানুষের হৃদয় জয় করা অনেক কঠিন। অস্ত্রের বলে, কৌশল প্রয়োগ করে রাজ্য জয় করা যায়। কিন্তু মানুষের হৃদয়রাজ্য জয় করতে হয় তাদের ভালোবেসে। সেই ভালোবাসাই এ দেশের মানুষকে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। তিনি তার স্বামী জিয়াউর রহমানের মতোই এ দেশ ও এ দেশের জনগণকে ভালোবেসেছেন। আর সে কারণেই তারাও পেয়েছেন জনগণের অকৃত্রিম ভালোবাসা।
ছোট্ট গৃহকোণ থেকে রাজনীতির সুপরিসর প্রান্তরে যখন বেরিয়ে এলেন খালেদা জিয়া, তখন তার বয়স মাত্র ৩৭ বছর। কী অদ্ভুত মিল! স্বামী জিয়াউর রহমানও ৩৭ বছর বয়সেই সমস্ত ভয়ভীতিকে তুচ্ছজ্ঞান করে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন! এ ছিল ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ প্রবচনের সার্থক উদাহরণ। কারণ, সবাই নিজের এবং পরিবারের জীবনকে থোড়াই কেয়ার করে দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না। জিয়াউর রহমান পেরেছিলেন। আর সেজন্যই তিনি বাংলাদেশের মানুষের একান্ত আপনজন। তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসার মানুষ। তেমনি খালেদা জিয়াও ওই একই বয়সে নেমেছিলেন এক ভয়ংকর যুদ্ধে। হ্যাঁ, সেটাও যুদ্ধই ছিল। সে যুদ্ধ ছিল এক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সে যুদ্ধ ছিল হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের যুদ্ধ। স্বামী জিয়াউর রহমানের মতো খালেদা জিয়াও সে যুদ্ধে সিপাহসালারের ভূমিকায় ছিলেন। পার্থক্য এটুকু, জিয়াউর রহমান সূচিত মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছিল মাত্র ৯ মাসে। আর গণতন্ত্র উদ্ধার করতে খালেদা জিয়াকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে ৯ বছর। কিন্তু ক্লান্ত হননি তিনি। ঝিমিয়ে পড়েননি। স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে, বন্দিত্বের নিপীড়নকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে পরে ফের স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন। দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সৈনিকদের কাফেলাকে নেতৃত্ব দিয়ে।
অনেকে মনে করেন, তিনি বোধ করি তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দলকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে সেদিন রাজনীতিতে এসেছিলেন। একদিক দিয়ে সেটা অবশ্য সঠিক। কেননা, সে সময় বহুধাবিভক্ত বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সেদিন রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ খালেদা জিয়াকে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল। সে সময়, মানে ১৯৮৩ সালে যারা খালেদা জিয়াকে বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণের অনুনয়-বিনয় করেছিলেন, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান তাদের মধ্যে অন্যতম। ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার সময় বারডেম হাসপাতালের কেবিনে বসে তিনি সে কথা বলেছিলেন আমাকে। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘অনেকেই ম্যাডামকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এমনকি আপনার সহযাত্রী মান্নান ভূঁইয়াও। প্লিজ নজরুল ভাই, ম্যাডামকে ছেড়ে যাবেন না।’ বেডে শায়িত নজরুল ভাই আমার ডান হাতটি ধরে বলেছিলেন, ‘মোহন, ম্যাডামের তো রাজনীতিতে আসার কথা ছিল না। তিনি আসতেও চাননি। আমরাই তো তাকে এই কঠিন জীবনে এনেছি। এই বিপদের দিনে তাকে ছেড়ে কি যেতে পারি?’ কথা রেখেছেন নজরুল ভাই। খালেদা জিয়াকে ছেড়ে যাননি তিনি। তারপরের ইতিহাস এখানে বিবৃত করা নিষ্প্রয়োজন। সবাই তা জানেন।
যে কথা বলছিলাম, বেগম জিয়া কি শুধু তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দলকে রক্ষা করতেই রাজনীতির বন্ধুর পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন? সেটা একটা দিক অবশ্যই। তারচেয়ে বড় হলো, তিনি দেশ ও দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই রাজনীতির এবড়োখেবড়ো পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন। এটা ছিল তার অন্তরে লালিত দেশপ্রেমের অভূতপূর্ব বহিঃপ্রকাশ। স্বামী জিয়াউর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ফার্স্টলেডি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন পর্দার অন্তরালে—নীরবে-নিভৃতে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য সৈনিক স্বামীর জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা, তারপর রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে বিলাসব্যসনে গা না ভাসিয়ে জনগণের কল্যাণে উদয়াস্ত পরিশ্রম, স্ত্রী হিসেবে তাকে অভিভূত ও দেশপ্রেমে, উদ্বুদ্ধ করেছে নিশ্চয়ই। সে দেশপ্রেমের কারণেই নিশ্চিন্তে নিরাপদে সন্তানদের নিয়ে পারিবারিক জীবন কাটানোর অবারিত সুযোগ থাকার পরও রাজনীতির মতো চড়াই-উতরাইয়ের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। সুতরাং তার একজন ভক্ত, অনুরাগী-অনুসারী হিসেবে নয়, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার মূল্যায়ন, অকৃত্রিম দেশপ্রেমই সেদিন স্বামীশোকে মুহ্যমান গৃহবধূ খালেদা জিয়াকে রাজপথে গর্জে উঠতে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
আমরা যদি খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের নির্মোহ পর্যালোচনা করি, তাহলে স্বীকার করতেই হবে, তার পুরোটা জীবনই সংগ্রামমুখর। যখন রাজপথে নেমেছিলেন তখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যখন রাষ্টক্ষমতায় ছিলেন, তখনো সংগ্রাম করেছেন দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য। সে সংগ্রাম ছিল আরও কঠিন। মোকাবিলা করতে হয়েছে দেশি-বিদেশি অপশক্তিকে। হার মানেননি তিনি।
একজন রাজনৈতিকত কর্মী হিসেবে আমার পরম সৌভাগ্য, খালেদা জিয়ার মতো একজন মহীয়সী নেত্রীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক কাফেলায় শরিক হতে পেরেছি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, এই মহান নেত্রীর সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। মহান আল্লাহ গফুরুর রাহিম তাকে পরিপূর্ণ সুস্থতা ও হায়াতে তৈয়্যেবা দান করুন। আমিন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন