ড. আবদুল আলীম তালুকদার
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভূমিকম্পে সতর্কতা ও করণীয়

ভূমিকম্পে সতর্কতা ও করণীয়

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার ভূমিকম্পের আঘাতে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শিশুসহ নিহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন ও আহত হয়েছেন কয়েকশ। পরপর কয়েক দফা ভূমিকম্প হওয়ায় জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে অতিসম্প্রতি শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কারণে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই; বরং প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসময় একজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় প্রায় ২১ লাখের মতো ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ লাখ ভবন দ্বিতল বা এর চেয়ে কম। এগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কম। কিন্তু চার থেকে ৩০ তলা পর্যন্ত বাকি ৬ লাখ ভবন উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। ভূমিকম্পের সময় এগুলো ধসে পড়লে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সংস্কারের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করে তোলার কথা বলা হচ্ছে।

ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এটা ঠিক কবে কখন ঘটবে সেটা নিশ্চিত করে বলার মতো কোনো প্রযুক্তি বা পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় যতটা সাফল্য এসেছে আমাদের, ভূমিকম্পে সেটা সম্ভব নয়। শুধু সচেতনতা, সঠিক নগর পরিকল্পনা ও সুপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণই পারে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে।

আগে থেকে সামান্যতম আঁচ করার উপায় নেই ভূমিকম্পের বিষয়ে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের বেলায় আগে থেকে বোঝা গেলেও ভূমিকম্প এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে যায় এ বিশাল দুর্যোগ, যার ফলে পূর্ব সতর্কতা নেওয়া সম্ভব হয় না। এর ফলে ক্ষয়ক্ষতিও হয়ে থাকে। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া দুরূহ ব্যাপার, তাই ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও সচেতনতার বিকল্প নেই। একমাত্র প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিই পারে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে ভূমিকম্প সহনশীল দেশ গড়ে তুলতে।

বুয়েট বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে যে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আছে সেটা বোঝা যাবে গত কয়েক বছর ছোট ও মাঝারি মানের ভূমিকম্প বহুবার হয়েছে। এটা বড় ভূমিকম্পের আলামত। ভূমিকম্পের যে রিটার্ন পিরিয়ড একশ বা দেড়শ বছর, আমরা কিন্তু তার কাছাকাছি অবস্থানে আছি। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনেক বেশি। ঢাকায় ঝুঁকি আরও অনেক বেশি। নিম্নবিত্তরা এক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। বিত্তবানরা যেসব ভবনে বসবাস করেন, সেগুলো হয়তো কিছুটা হলেও বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোয় ঝুঁকি কম। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ যেসব ভবনে বসবাস করেন, সেগুলোয় ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ, অনেক ভবন জলাশয় বন্ধ করে তৈরি করা হয়েছে। এ ভবনগুলো এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। আর কোনো কারণে ভূমিকম্প আঘাত হানলে রাস্তাগুলো এত ছোট যে, সেখানে উদ্ধারকারী যানবাহনগুলোই যেতে পারবে না। ফলে আমাদের ঝুঁকি তুলনামূলক অনেক বেশি।

সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বাংলাদেশেও মিয়ানমারের মতো একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে। বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য সব পর্যায়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতা তৈরির প্রয়োজন বলে তারা মত প্রকাশ করেন।

ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের পরামর্শ হচ্ছে, ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সব বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। জরুরি পরিষেবাসমূহ যথা গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইনের সঠিকতা নিশ্চিত করতে হবে। ভূমিকম্প চলাকালীন সময়ে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি পর্যায়ে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত মহড়া অনুশীলন ও প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসপাতাল ও অন্যান্য জরুরি নম্বর ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সব ভবন বা স্থাপনায় সংরক্ষণ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দুর্যোগকালীন সময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা। জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি যেমন—টর্চলাইট, রেডিও (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ), বাঁশি, হ্যামার, হেলমেট বা কুশন, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী, ফার্স্টএইড বক্স, শিশু যত্নের সামগ্রী ইত্যাদি বাসাবাড়ির নির্ধারিত স্থানে সংরক্ষণ করা যাতে ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে আটকা পরলে তা ব্যবহার করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যায়। সব পর্যায়ে তদারকি সংস্থার কার্যক্রমে সহযোগিতা করা।

ভূমিকম্পের সময় যা করণীয়

ভূমিকম্প বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। যতটুকু সময় স্থায়ী হয় ততক্ষণে আতঙ্কিত হয়ে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বরং নিজেকে শান্ত রাখতে হবে এবং পরিবারের সবাইকে বারবার সতর্ক করে দিতে হবে। ভূমিকম্প হলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমাতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তা বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে ১২টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

ভূকম্পন অনুভূত হলে আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত থাকুন; ভূমিকম্পের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নিন। অতঃপর টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনো আসবাবের নিচে আশ্রয় নিন এবং তা এমনভাবে ধরে থাকুন—যেন মাথার ওপর থেকে সরে না যায়। এ ছাড়া শক্ত দরজার চৌকাঠের নিচে, বিম, কলাম ও পিলার ঘেঁষে আশ্রয় নিন। এ ছাড়া যদি ভবনের নিচতলায় থাকেন, তাহলে দ্রুত বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসুন। আর যদি ভবনের ওপর তলায় থাকেন তাহলে কক্ষের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন। উঁচু বাড়ির জানালা, বারান্দা বা ছাদ থেকে লাফ দেবেন না। ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনির পর ফের ঝাঁকুনি হতে পারে। সুতরাং একবার বাইরে বেরিয়ে এলে নিরাপদ অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত ভবনে প্রবেশ করবেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে স্কুলব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন। পাশাপাশি রান্নাঘরে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসুন। সম্ভব হলে বাড়ির বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মেইন সুইচ বন্ধ করুন। মোবাইল বা ফোন ব্যবহারের সুযোগ থাকলে উদ্ধারকারীদের আপনার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, মার্কেট বা শপিংমল ও সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দুহাতে মাথা ঢেকে বসে পড়ুন। দুর্ঘটনার সময় লিফট ব্যবহার করবেন না। যদি কোনো বিধ্বস্ত ভবনে আটকা পড়েন এবং আপনার ডাক উদ্ধারকারীরা শুনতে না পান, তাহলে বাঁশি বাজিয়ে অথবা হাতুড়ি বা শক্ত কোনো কিছু দিয়ে দেয়ালে বা ফ্লোরে জোরে জোরে আঘাত করে উদ্ধারকারীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করুন। ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিন। গাড়িতে থাকলে ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামান। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরেই অবস্থান করুন। ভাঙা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়াচড়ার চেষ্টা করবেন না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন যাতে ধুলাবালু শ্বাসনালিতে না ঢুকে এবং উদ্ধারকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করুন। একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিন। ওপর তলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে বা লিফট ব্যবহার করে নামা থেকে বিরত থাকুন। কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন এবং খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিন। ব্যাটারিচালিত রেডিও, টর্চলাইট, পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম বাড়িতে রাখুন। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় অসহায় মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ

বিসিবিএল ও ‘এফসিডি-সিএবি’র সমঝোতা স্মারক

লিবিয়ায় ৪০ বাংলাদেশি আটক

রূপগঞ্জে বিএনপি চেয়ারপার্সনের সুস্থতা কামনায় দোয়া-মোনাজাত

বিপিএলে ফিক্সিং রোধে যে পদক্ষেপ নিল বিসিবি

নির্বাচনের জন্য আরও বেশি সমঝোতা-ঐক্য প্রয়োজন : ডা. তাহের

ছাত্রদলের কর্মসূচি ঘোষণা

দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথের লড়াই অব্যাহত থাকবে : ডা. শফিকুর রহমান

তদন্ত কমিটি গঠন / ‘মিনিস্ট্রি অডিটে ঘুষের রেট এক মাসের বেতন’ প্রতিবেদনে তোলপাড়

জুয়ার টাকার জন্য স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ স্বামীর বিরুদ্ধে

১০

জোড় ইজতেমার আখেরি মোনাজাত মঙ্গলবার

১১

কর্মবিরতির কারণে প্রাথমিকের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত

১২

ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের দিলীপের ফ্ল্যাট-দোকানসহ সম্পদ ফ্রিজ

১৩

উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে এডুকেশন অ্যান্ড অ্যাডমিশন ফেয়ার শুরু

১৪

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কড়াইলবাসীর পাশে দেশবন্ধু গ্রুপ

১৫

বস্তায় ভরে পুকুরে ডুবিয়ে ৮ কুকুর ছানা হত্যা

১৬

জোটবদ্ধ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বিধান কেন অবৈধ নয়, হাইকোর্টের রুল

১৭

চলতি মাসে আসছে টানা ৩ দিনের ছুটি

১৮

নেতানিয়াহুকে দুঃসংবাদ দিলেন তার সাবেক আইনজীবী

১৯

বাংলাদেশে কারাদণ্ডের রায়ে টিউলিপের প্রতিক্রিয়া

২০
X