

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ সময়োচিত, স্পষ্ট এবং রাজনৈতিকভাবে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদ বিষয়ে গণভোটকে তিনি শুধু একটি সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তা নির্ধারণের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার ভাষণে বারবার উচ্চারিত হয়েছে একটি মূল বার্তা—ভোট রক্ষা করা মানেই দেশ রক্ষা করা।
প্রধান উপদেষ্টা সতর্ক করেছেন, পরাজিত ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলো নির্বাচন ঘিরে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে মরিয়া। তরুণ প্রজন্মকে তারা নিজেদের পুনরুত্থানের প্রধান বাধা হিসেবে দেখছে এবং সে কারণেই সহিংসতা, চোরাগোপ্তা হামলা ও গুজব ছড়িয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার চেষ্টা চলছে। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনাকে তিনি শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়, বরং রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ওপর আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেন। এ বক্তব্য স্পষ্ট করে, সহিংসতার রাজনীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান দৃঢ়।
ভাষণে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও তার চিকিৎসা নিয়ে সরকারের মানবিক অবস্থানও তুলে ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও একজন জাতীয় নেত্রীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার ঘোষণা অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার বার্তা দেয়। এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিপরীতে মানবিক রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার, রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক সংস্কার এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ বক্তব্যের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখাকে স্পষ্ট করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়, দণ্ডিতদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ এবং আইন ও কাঠামোগত সংস্কারের তথ্য ভাষণকে শুধু বক্তব্য নয়, বরং চলমান প্রক্রিয়ার বিবরণে পরিণত করেছে। জুলাই জাতীয় সনদকে আদেশ আকারে জারি করা এবং এর ওপর গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রসংস্কারে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার এক নতুন অধ্যায়। ভাষণের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো ভোটের রাজনৈতিক ও নৈতিক গুরুত্বের ওপর জোর। ভোটকে ‘কাগজে সিল মারা’ নয়, বরং রাষ্ট্র বিনির্মাণে নাগরিক স্বাক্ষর হিসেবে দেখার আহ্বান সচেতন নাগরিক সমাজ গঠনের বার্তা দেয়। তবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য অর্জনে শুধু বক্তব্য যথেষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশন, মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত দায়িত্বশীল আচরণই নির্ধারণ করবে এ নির্বাচন ও গণভোট সত্যিকারই উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য হবে কি না। প্রশাসনিক রদবদলের ব্যাখ্যায় দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর জোর দেওয়া হলেও এর বাস্তব প্রয়োগেই জনগণের আস্থা টিকবে।
আমরা মনে করি, বিদ্যমান জটিল পরিস্থিতিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিজয় দিবসের ভাষণ একটি দিকনির্দেশনামূলক রাজনৈতিক দলিল। এতে অতীতের সহিংসতা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ভবিষ্যতের জন্য গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও নাগরিক ক্ষমতায়নের রূপরেখা। এখন দেশবাসীর দায়িত্ব ভোটের মাধ্যমে সেই রূপরেখাকে বাস্তব রূপ দেওয়া। আমাদের প্রত্যাশা, দেশবাসী ভোট রক্ষার মাধ্যমে দেশকে রক্ষার আন্দোলনে শামিল হবে। কেননা, ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করার অন্যতম উপায় হলো নির্বাচনী সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনা এবং এটাকে এগিয়ে নেওয়া।
মন্তব্য করুন