আফাফ আল-নাজ্জার
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৩১ এএম
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১:১৩ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যুদ্ধবিরতি ছিল যুদ্ধের চেয়ে বেশি মর্মান্তিক

যুদ্ধবিরতি ছিল যুদ্ধের চেয়ে বেশি মর্মান্তিক

গাজায় যুদ্ধবিরতির পর আবারও শুরু হয়েছে ইসরায়েলি নির্মমতা। এর আগে স্বল্প সময়ের যুদ্ধ বিরতিতে কেমন ছিল এখানকার পরিস্থিতি? অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রথম দিনে আমরা অনেকেই যার যার অবস্থান থেকে বের হতে সাহস পাইনি। আমরা খুবই ভয়ে ছিলাম এবং ধরে নিয়েছিলাম যে, এই যুদ্ধবিরতি আদতেও হবে না বা টিকবে না। দ্বিতীয় দিনে আমরা সাহস সঞ্চয় করে বেরিয়ে পড়লাম। দিনের আলো গত সাত সপ্তাহ ধরে গাজায় ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞকে আলোকিত করেছে। আমরা আমাদের আশপাশের এলাকা এবং রাস্তাঘাট চিনতে পারিনি। সেখানে পুরো ফাঁকা জমি আর ধ্বংসস্তূপ ছিল; যেখানে একটি ভবনও দাঁড়িয়ে ছিল না। কিছুই রেহাই দেওয়া হয়নি; বাড়ি, আবাসিক ভবন, দোকান, বেকারি, ক্যাফে, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি, শিশুযত্ন কেন্দ্র, মসজিদ, গির্জা—সবই ধ্বংসের শিকার হয় ইসরায়েলের আক্রমণে। এমন ধ্বংসযজ্ঞ আমরা এই প্রথম দেখেছিলাম। তারপর যন্ত্রণায় বুক ভেঙে এলো।

চরম আতঙ্কের মধ্যে আমাদের অনেকেই বোমা থেকে বাঁচার জন্য ছুটে চলা, প্রিয়জনদের হারানো, সম্পদের ক্ষতি, জীবনহানি, হতাহতের ঘটনা, স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া—এসব অনুধাবনের বোধশক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে তাদের প্রিয়জনদের মৃতদেহ দাফন করতে পারেননি। অনেকে শোক প্রকাশও করতে পারেননি। গাজার একজন মেডিকেল ছাত্র সাবরি ফারা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘বিপর্যয় শব্দটি আমাদের অবস্থা বর্ণনা করার জন্য যথেষ্ট নয়। এটি ফিলিস্তিনি জনগণকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য সৃষ্ট অগ্নিকুণ্ড।’

যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই আমি গাজা শহরে থাকা আমার বাড়ি ছেড়েছিলাম। আমি ভাগ্যবান যে, আমি বাড়ি ছাড়ার সুযোগ পেয়েছি। একই দিনে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধারকৃত অধিবাসীদের বহনকারী একটি গাড়িবহরে বোমা হামলা চালায় এবং সেই হামলায় কমপক্ষে ৭০ জন নিহত হয়। ইসরায়েল যে রাস্তাটি আমাদের অধিবাসীদের উত্তর থেকে দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ‘নিরাপদ রুট’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল, তা আদৌ নিরাপদ ছিল না, ছিল ভয়ংকর ও বিপৎসংকুল। গত সাত সপ্তাহ ধরে যারা এই রাস্তা দিয়ে দক্ষিণে যেতে পেরেছে, তারা সর্বত্র বেসামরিক লোকদের মৃতদেহ পড়ে থাকার বেদনাদায়ক দৃশ্য দেখেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে এই ভয়াবহতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

যখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তখন আরও অনেক ফিলিস্তিনি উত্তর থেকে দক্ষিণে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আশা করে ছিল যে, এই রাস্তাটি নিরাপদ হবে। কিন্তু তারা যখন দক্ষিণে পথ চলতে শুরু করে, তখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চেকপয়েন্টের সম্মুখীন হয়, যেখানে তাদের থামিয়ে তল্লাশি করা হয় এবং তাদের সহায়-সম্বল কেড়ে নেওয়া হয়। আমার পরিবারের নারীরা এবং বান্ধবীরা আমাকে জানায় যে, ইসরায়েলি সেনারা তাদের স্বর্ণ নিয়ে গেছে। পরিচয়পত্র ছাড়া সবকিছু রেখে দিয়ে শূন্য হাতে তাদের হাঁটতে বাধ্য করা হয়। যারা এর মধ্য দিয়ে গেছে তারা ভাগ্যবান। কারণ ইসরায়েলি সেনারাও পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদ হওয়াদের অপহরণও করছে। আমার ভাইবোনদের সঙ্গে অনেক বন্ধু আছে, যাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং নির্ধারিত ‘নিরাপদ রুট’ দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করার পরও তারা নিখোঁজ রয়েছে। এমনকি ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহাকেও গ্রেপ্তার করে। তার মুক্তির জন্য ব্যাপক আন্তর্জাতিক প্রচারণার পরই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। অপহৃতদের প্রকৃত সংখ্যা আমরা এখনো জানি না।

একটানা হাঁটলে উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে প্রায় আট ঘণ্টা লাগে। এটি এমন এক যাত্রা, যা সম্পন্ন করতে অনেক ফিলিস্তিনির বর্ণনাতীত কষ্ট করতে হয়েছে। কারণ তারা ছিল অনেক বৃদ্ধ, একেবারেই অল্পবয়সী, খুবই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, আহত বা পঙ্গু। একদিকে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে অপহরণ করার শঙ্কা ছিল। কিন্তু এর বিপরীত দিকে গেলে জীবন হারানো ছিল নিশ্চিত। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর লিফলেট ফেলে এমন গমনাগমনের চেষ্টা না করার জন্য সতর্ক করেছিল। যুদ্ধবিরতির প্রথম দিনেই ইসরায়েলি সেনারা উত্তরাঞ্চলে ফিরে যাওয়ার চেষ্টারত অন্তত দুজনকে হত্যা করেছে।

হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মতো আমারও গাজা শহরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসা নিষিদ্ধ ছিল। আমার কষ্টটা হলো আমি আমার বাড়িতে গিয়ে দেখতে পারি না যে, বাড়িটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে কি না। আরও অনেকে, যাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে বা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে, তারা তাদের প্রিয়জনের লাশ উদ্ধার কিংবা যথাযথভাবে দাফন করতে পারেনি।

ইসরায়েল আমাদের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা কোথায় যাই, আমরা কী করি, আমরা কতটা খাই বা পান করি, আমরা আহত বা ধ্বংসস্তূপের নিচে কয়েকদিন আটকে থাকব, আমাদের লোকদের বাঁচাতে পারব কি না—এসবই ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি আমরা আমাদের মৃতদের নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেব, সেটাও ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। নির্বিচারে বোমাবর্ষণ এবং গণহত্যা ফের শুরু করার আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের আরও বেশিসংখ্যক জনগণকে ক্রমাগত সংকুচিত ভূখণ্ডে নিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েল মানবিক সাহায্যের যেসব ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে, তা মানবিক বিপর্যয় কমাতে পারবে না। আমরা শুধু বেঁচে আছি। যদি বোমা আমাদের নাও মেরে ফেলে; ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ওষুধের অভাব বা ঠান্ডাই আমাদের মেরে ফেলবে।

এই যুদ্ধবিরতি যুদ্ধ চলার আগের ৫০ দিনের চেয়ে বেশি বেদনাদায়ক ছিল। এই প্রথম গাজার জনগণ তাদের দেহের খোলা ক্ষত, শহীদ হওয়া শিশু, গলা কেটে মেরে ফেলা নিজ পরিবারের সদস্য, ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ি এবং ছিন্নভিন্ন জীবন স্বচক্ষে দেখতে পেল। সপ্তম দিনের জন্য আপনার মৃত্যুর প্রস্তুতি ও অপেক্ষার আগের ছয় দিন বেঁচে থাকার কথা একবার কল্পনা করুন তো!

লেখক ও অনুবাদক: ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী, অ্যাক্টিভিস্ট ও স্বাধীন সাংবাদিক। আলজাজিরার মতামত বিভাগে প্রকাশিত তার এই লেখাটি ঈষৎ ভাষান্তর করেছেন গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত মেজর ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যুদ্ধবিরতি বৈঠক / ‘আমি বৃহস্পতিবার তুরস্কে পুতিনের জন্য অপেক্ষা করব’

‘পিন্ডি না ঢাকা’ বিষয়ে মাহিন সরকারের ব্যাখ্যা

সামনে বহু লড়াই বাকি : হান্নান মাসউদ

‘তারেক রহমান ডাক দিলে নির্বাচনের দাবিতে ঢাকায় লাখো লোক জমায়েত হবে’

সন্ত্রাসে জড়িত ব্যক্তি ও সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা যাবে

মাদকসেবির হামলায় পুলিশের এসআই আহত

লঞ্চে দুই তরুণীকে মারধরের ঘটনায় মামলা

ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ৬ ডাকাত গ্রেপ্তার

দেশের প্রথম বন খেজুর গাছের সন্ধান দিনাজপুরে

ইতালি পালেরমোতে দুই বাংলাদেশি আটক

১০

বিএনপি নেতার বাড়ি থেকে যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১১

আ.লীগকে বিচারের আওতায় আনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাল গণসংহতি আন্দোলন

১২

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল সোমবার

১৩

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় বিশ্বকাপ স্থগিত

১৪

ইবিতে ‘ডি’ ইউনিটের ফলাফল ঘোষণা

১৫

পা দিয়ে লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন মানিক

১৬

‘কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে সেটা চাঁদাবাজি নয়’

১৭

নাটোরে বিএনপির মতবিনিময় সভায় গুলি ছোড়ার অভিযোগ

১৮

‘হাসিনার সময় ওয়াজ নিষিদ্ধ ছিল’

১৯

হোটেল কর্মচারীর গায়ে গরম মাড় নিক্ষেপ, অতঃপর...

২০
X