ড. কামালউদ্দিন আহমেদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা; সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব। মানবাধিকার দিবসে কথা বলেছেন কালবেলার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রীতা ভৌমিক।
কালবেলা: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন কেমন?
ড. কামালউদ্দিন আহমেদ: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ বলার মতো এমন কিছু নেই। যেখানে যেখানে যে ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে তা গুরুত্ব সহকারে দেখি। নিপীড়িত সাধারণ মানুষ যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে আমরা প্যানেল আইনজীবী দিয়ে তার সহায়তার জন্য আইনি লড়াই শুরু করি। একইসঙ্গে চেষ্টা করা হয় যাতে তিনি ন্যায়বিচার, সুবিচার পায়, তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
আমাদের সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে, সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার কথাটি বলা হয়েছে। ‘প্রজাতন্ত্রী হলো গণতন্ত্র। যেখানে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’
২৭ থেকে ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদের তৃতীয় অধ্যায়ে, সুস্পষ্টভাবে মৌলিক অধিকার কথাটি বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ইউনির্ভাসেল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে মানবাধিকারকে সমুন্নত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সবাই সেই অনুযায়ী কাজ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি নওগাঁয় সুলতানা জেসমিনকে অফিসে যাওয়ার পথে গ্রেপ্তার করা হয়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়েছি। তিনি যদি অপরাধ করে থাকেন ধরার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। এটি র্যাপিডলি ধরার কেস ছিল না। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কাজটি অন্যায় হয়েছে। পরে তিনি মারাও গেছেন। আমরা তার মৃত্যুর সঠিক তদন্ত ও বিচার করার কথা বলেছি। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচার করতে হবে। আমরা একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তদন্ত ও বিচার শুরু হয়েছে। তারা বলেছেন, এটা একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল।
সরকারও যে কোনো ধরনের অন্যায় করে থাকলে বলে থাকি, অন্যরাও যে কোনো ধরনের অন্যায় করে থাকলে বলে থাকি। সহনশীলতা ও ধৈর্যের সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করা, দেশের একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করা। বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতার কারণে শিশুরা, শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। এর মাধ্যমে আমাদের জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মানবাধিকারের বক্তব্য হলো, আমাদের দেশে সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল, রাজনৈতিক দলগুলো সমাবেশ করছিল শান্তিপূর্ণভাবে। গত ২৮ অক্টোবরের পরে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, এগুলো দুঃখজনক এবং ক্ষেত্রবিশেষে মর্মান্তিক। অনেক মানুষ যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। বা তারা নিদারুণ কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন। যেটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
কালবেলা: রাজনৈতিক কারণে পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে? আমাদের মানবাধিকার সংস্থা এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে?
ড. কামালউদ্দিন আহমেদ: আপনি পশ্চিমা দেশগুলোর কথা বলেছেন, কোনো একটি দেশ অন্য একটি দেশের মানবাধিকার যদি লঙ্ঘন করে তাহলে কথা বলার এখতিয়ার অন্য দেশের আছে। অনেক সময় আমরা বলে থাকি, এটা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় হয়, তখন সেটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপার থাকে না।
ধরা যাক, এক দেশের জনগণ আরেক দেশের জনগণকে নিপীড়ন করল। এতে তার মানবাধিকার হরণ করা হলো। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও মন্তব্য করতে পারবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতি অনুযায়ী জাতিসংঘের একটা মেকানিজম রয়েছে। ইউনির্ভাসেল পিরিয়ডে যে কেউ ইউপিআরের মাধ্যমে তার অভিযোগ জানাতে পারেন। তখনই ইউপিআর এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নেয় এবং অভিযুক্ত দেশগুলোকে ডাকে। তারা বলে, আপনার দেশে এই এই মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। আপনি এটার ক্ষেত্রে কী বলবেন? সেই দেশকে জবাবদিহি করতে হয়। তারা তখন বলে, আমরা এটি করিনি। সেটা যৌক্তিকভাবে যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে সেই দেশের ব্যাপারে জাতিসংঘ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করে, সরাসরি আমাদের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করে, এটা কিন্তু আন্তর্জাতিক নীতি-নিয়মের বরখেলাপ।
চলতি বছরের ১৩ থেকে ১৫ নভেম্বর জেনেভায় ইউপিআরএ সেশন হয়েছে, অন্যান্য দেশ আমাদের দেশ সম্পর্কে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কী ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো শুনেছে। সেখানে আমাদের দেশকে জবাবদিহি করতে হয়েছে। তবে আশ্চর্যজনক যে, কোনো কোনো দেশ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরাসরি একটি দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক বা পারস্পরিক যোগাযোগের ভিত্তিতে একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশ সম্পর্ক রক্ষা করছে। যেমন, আমাদের দেশের সঙ্গে উচ্চমানের অর্থনীতিসম্পন্ন একটি দেশের সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে তারা যদি আমাদের চাপের মুখে রাখতে চায়, সেটি অন্যায়। এটি আরেকটি মানবাধিকার লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনির গাজায় যে ঘটনাগুলো প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি, পাঁচ-ছয় দিন আগে ৭০০ মানুষকে হত্যা করেছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন। যেসব দেশ এদেরকে কিছু বলছে না, আমাদের দেশে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সেসব সম্পর্কে উল্টো তাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রসারিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। সেটা লজ্জাজনক।
কালবেলা: আন্তর্জাতিক মহল থেকে মানবাধিকার বিষয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কি না?
ড. কামালউদ্দিন আহমেদ: এক দলের সঙ্গে আরেক দলের ঝগড়া, বাদানুবাদ হয় এর ভেতরে প্রবেশ করা সমীচীন নয়। আমরা নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছি। সচরাচর বলে থাকি, আমরা বক্তব্য পাঠিয়েছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছি, আপনারা সহনশীল হন। কোনো পুলিশ যেন অন্যায়ভাবে কারও ওপর জোর প্রয়োগ না করে, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছি।
কালবেলা: এই সময়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোন ধরনের অভিযোগ আসছে? সে ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ড. কামালউদ্দিন আহমেদ: জাতীয় মানবাধিকারে যে অভিযোগ পাই, সেগুলো তদন্ত করি। নারী ও শিশু নির্যাতন, শিশুদের সম্ভ্রমহীন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, তাদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার করা, গৃহপরিচারিকাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলা। দলিত, হরিজন যারা তাদের উৎখাত করা, ট্রান্সজেন্ডার, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে খাটো চোখে দেখা, চাকরি, লেখাপড়া করতে না দেওয়া, তাদের কষ্টকর অবস্থায় রাখা। এসব বহুবিধ মানবাধিকার লঙ্ঘন রয়েছে। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করি। হোচিমিনকে অপমানজনকভাবে বলার অধিকার ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেই। আমরা প্রতিবাদ করেছি।
কালবেলা: মানবাধিকার কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও আরও কার্যকর করার ক্ষেত্রে আপনার চিন্তা-ভাবনা কী?
ড. কামালউদ্দিন আহমেদ : অবশ্যই চিন্তাভাবনা রয়েছে। মানবাধিকার কমিশন ২০০৯ অনুযায়ী যে ম্যান্ডেট রয়েছে, প্রতিটি ম্যান্ডেট সঠিকভাবে প্রতিপালন করা। এটি প্রতিপালন করতে গেলে স্পেকটা, আমাদের কাজের ক্ষেত্র অনেক বেশি প্রসার করতে হবে। বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে প্রতিটি বিভাগের বিভাগীয় এবং ৬৪টি জেলা ও উপজেলা অফিস যেটা আইনে রয়েছে, সেটা করতে পারলে আমরা কাজে বিস্তৃতি আরও অবস্থান নিতে পারব। সেটা আমরা এখনো করতে পারিনি। চেষ্টায় রয়েছি। মানবাধিকারের বিষয়গুলো আরও এখতিয়ারে নিতে পারব। তাহলে আমাদের দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা দুর্নীতিমুক্ত, মানুষকে সহায়তাকারী একটি প্রতিষ্ঠান।