প্রতিবছরই কোরবানির ঈদের আগে ও পরে কয়েকটা দিন চামড়ার দাম নিয়ে হৈচৈ হয়। এরপর সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ফলে গড়ে উঠছে না কোনো টেকসই ব্যবস্থা।
কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণে প্রতিবছরই সরকারের ভুলের সুযোগ নিচ্ছে খাতসংশ্লিষ্টরা। মাঠপর্যায়ে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হলেও দাম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে লবণযুক্ত চামড়ার। এতে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের ব্যবসায় বেশ সুবিধা হলেও, কোরবানি মৌসুমে সারা দেশে কাঁচা চামড়া বেচাকেনায় সেই পুরোনো নৈরাজ্যই বারবার ঘুরে-ফিরে আসছে। এবারও এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি।
বরাবরের মতো ন্যায্য দাম না পাওয়ার অভিযোগ তো আছেই। কোথাও কোথাও মাত্র ১০ টাকায় দাম চেয়েও বিক্রি করা যায়নি খাসির চামড়া। এমনকি ৭০ পিস চামড়া মাত্র ২০০ টাকায় বিক্রি হওয়ারও নজির তৈরি হয়েছে রাজশাহীতে। অন্যদিকে অতিবৃষ্টি, গরম, পরিবহন সংকট, বর্ষাকালে যাতায়াত সমস্যা এবং সময়মতো লবণ না মাখানোর কারণে এবার গরুর ১০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ ছাগলের চামড়া পচে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে ট্যানারি শিল্পের ইতিহাস প্রায় শতাব্দী পার হলেও পশুর শরীর থেকে চামড়া ছাড়ানোর ত্রুটির কথা এখনো শুনতে হচ্ছে। যার কারণে নাকি আরও ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া কোরবানির স্পট থেকে চামড়া সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা, লবণ সরবরাহে সংকট ও বাড়তি দাম—সবকিছুতেই ভূতের আসর আঁকড়ে ধরেছে। ফলে বছর যায়, ফের দরজায় কোরবানির মৌসুম কড়া নাড়ে; কিন্তু চামড়ার দামে অসন্তুষ্টি দূর হয় না। চামড়ায় চেপে বসা ভূতের আসরও তাড়ানো যাচ্ছে না।
উদ্বেগজনক খবর হলো, বাংলাদেশের লেদার কারখানাগুলো অনেক বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে পাকা চামড়া আমদানি করে থাকে তাদের চাহিদা মেটাতে। অন্যদিকে দেশের চামড়া হয় পচে যায় কিংবা পানির দামে বিক্রি করতে হয়। এবার দাম না পেয়ে মাটির নিচে চামড়া পুঁতে রাখার খবর পাওয়া যায়নি, এটুকুই সান্ত্বনা।
এ বছর এক কোটির বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। দেশে বছরে যত পশু জবাই হয়, তার অর্ধেকই হয় কোরবানির সময়। এ বিপুল পরিমাণ চামড়া পরিবেশসম্মতভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত করার জন্য যে সক্ষমতা ও দক্ষতা দরকার, সেটা আমাদের নেই। সক্ষমতা অর্জনের তেমন চেষ্টাও করা হয়নি। একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছেন সবাই।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মানোন্নয়নে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে চামড়া ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ঋণের টাকায় যে চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তার মান নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা নেই। আবার ব্যবসায়ী তথা আড়তদাররা সেকেলে পদ্ধতিতেই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে থাকেন, যা আন্তর্জাতিক বাজার দূরের কথা, দেশীয় বাজারও ধরতে পারে না।
বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের বিদেশে প্রচুর চাহিদা আছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসাও করছে। এ অবস্থায় দেশীয় চামড়ার বাজার ধরে রাখতে এর সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ উন্নত করার বিকল্প নেই। এ বিষয়ে চামড়া ব্যবসায়ী ও চামড়া শিল্পের মালিকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান বের করতে হবে।
মন্তব্য করুন