বুদ্ধদেব গুহ বাংলা সাহিত্যের একজন অনন্য কথাসাহিত্যিক। মূলত নরনারীর প্রেমকে উপজীব্য করেই তিনি গেঁথেছেন কথামালা। তার ভাষায় একটা কোমলতা আছে, যা পাঠকদের টেনে নেয়, জড়িয়ে রাখে। তবে তিনি অনন্য আসলে তার প্রকৃতি প্রেমের জন্য। তার উপন্যাসে এমনভাবে প্রকৃতির কথা উঠে আসে, ভালো না বেসে উপায় থাকে না। বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব গুহর মতো করে প্রকৃতিকে তুলে আনা লেখক খুব বেশি নেই। বুদ্ধদেব গুহর অন্যতম জনপ্রিয় একটি উপন্যাসের নাম ‘একটু উষ্ণতার জন্য’। আজকের লেখা সাহিত্য বা প্রকৃতি নিয়ে নয়। বুদ্ধদেব গুহ নিয়েও নয়। বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে হঠাৎ ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ নামটি মনে পড়ল। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এখন একটু উষ্ণতার জন্য হাহাকার। পৌষের মাঝামাঝি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিনের আবেশ নেই। এখনো মাঝেমধ্যে রাতে ফ্যান চালিয়ে ঘুমাতে হয়। প্রকৃতিতে শীতের জন্য হাহাকার আর রাজনীতিতে চলছে উষ্ণতার সন্ধান।
বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই উৎসব। বাংলাদেশে বড় নির্বাচনগুলো সাধারণত শীতকালেই হয়। জাতীয় নির্বাচন তো বটেই, এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দেশজুড়ে উৎসবের আবহ তৈরি হতো। মনে আছে ছেলেবেলায় আমরা বিভিন্ন নির্বাচনে প্রায় সব দলের মিছিলেই অংশ নিতাম। ব্যক্তি, দল বা প্রতীকের চেয়ে মিছিলের স্লোগানের ছন্দটাই বেশি টানত আমাদের। স্লোগান আমাদের রক্তে দোলা দিত। কিন্তু নির্বাচন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা হারিয়ে যাওয়ায়, উধাও হয়ে গেছে উৎসবের আমেজও।
বাংলাদেশে নির্বাচনকে প্রহসন বানানোর কাজটা শুরু করেছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৭ নভেম্বর ঘটনাক্রমে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। ক্যান্টনমেন্টে বসেই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন দেশ ও রাজনীতি। শুরুতে না আসার কথা বললেও ধাপে ধাপে রাজনীতিতেও আসেন জিয়াউর রহমান। প্রথমে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট করে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন তিনি। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই জিয়া হয়ে যান রাষ্ট্রপতি। উর্দি পরা অবস্থাতেই ওই বছরের ৩০ মে অনুষ্ঠিত গণভোটে ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পড়ে ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে। অবিশ্বাস্য এই ফলাফল এক বিশ্বরেকর্ডও বটে। বিশ্বের আর কোনো নির্বাচনে কেউ ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে কি না সন্দেহ। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সব আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায়ই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন জিয়াউর রহমান। ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। সে নির্বাচনে কোনো কোনো আসনে ১১০ ভাগ ভোট পড়ার অবিশ্বাস্য রেকর্ডও হয়েছে।
জিয়াউর রহমান এবং তার স্টাইলে ক্ষমতায় আসা এইচ এম এরশাদের আমলে জাতীয় সংসদের তিনটি নির্বাচন হয়েছে। তিনটিতেই ক্ষমতাসীনদের বিপুল বিজয় দেখানো হয়েছে। তখন আসলে নির্বাচন মানেই ছিল ‘হুন্ডা, গুন্ডা, ডান্ডা; নির্বাচন ঠান্ডা’। তারপর ছিল মিডিয়া ক্যু।
১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর ’৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের মানুষ প্রথম ভোট দেওয়ার আনন্দ পায়, জাতীয় নির্বাচনে উৎসবের রং লাগে। ’৯১ থেকে ২০০৮—এ সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চারটিই হয়েছে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, উৎসবমুখর। মাঝে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থারই এক কলঙ্ক। ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশের নির্বাচন তার রং, রূপ, উৎসব—সব হারিয়েছে। যে দুই দল দীর্ঘ আন্দোলন করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিল, সেই দুই দলই নির্বাচন খেলো বানানোর জন্য দায়ী। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের দায় অবশ্যই বেশি। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকেই বিএনপি কার্যত নির্বাচনী ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে প্রতিবারই ক্ষমতার বদল হয়েছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের মতো সাজিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টাটা বিএনপিই করেছিল। বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানানোর আইডিয়াটা বিএনপির আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের। সেই আইডিয়া যখন কাজ করল না, তখনো শিক্ষা নেয়নি বিএনপি। বরং তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজে প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণারই কবর রচনা করে দিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মেরে লাশ বানিয়েছে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ এসে সেই লাশ দাফন করেছে। সমস্যা হলো যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মেরেছে বিএনপি, সেই সরকারের জন্যই এখন তাদের সব মায়াকান্না। ক্ষমতায় আসতে পারবে না জেনে বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচনেই এলো না। অথচ তখন মাঠের যে পরিস্থিতি ছিল, নির্বাচনে এলে বিএনপি ক্ষমতায় না এলেও রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারত দারুণভাবে। নির্বাচনের বাইরে থাকার সে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের খেসারত দিচ্ছে এখন বিএনপি পদে পদে। জয়ই যদি নির্বাচনে যাওয়ার একমাত্র লক্ষ্য হয়, তাহলে সেটা গণতন্ত্রের জন্য তো বটেই, রাজনীতির জন্যও মুশকিল। ১৯৭৯ সালে হারবে জেনেও নির্বাচনে গিয়েছিল বলেই আওয়ামী লীগ প্রবল প্রতাপে রাজনীতিতে ফিরতে পেরেছে, টিকে থাকতে পেরেছে। ২০১৪ সালে না এলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে সেটা ছিল আরও হৃদয়বিদারক। তারা সেবার অংশ নিয়েছিল নিজেদের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে আর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়; সেটা প্রমাণ করতে। তাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি প্রহসন হয়েই আছে। তবে নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি নিজেদের অস্তিত্ব আবার ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন খুব খারাপ হয়েছে, এটা ছাড়া বিএনপির আর কোনো অর্জন নেই। সে নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিএনপি মাঠে, মাঠের বাইরে বা আদালতে কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে পারেনি।
২০২৪ সালের নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না বিএনপি। তারা এখন সরকার পতনের একদফা আন্দোলন করছে। সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আর দিন কয়েক বাকি থাকতেও আন্দোলন বা অসহযোগ কোনোটাতেই তারা সফল নয়। নির্বাচনে যেমন উত্তাপ নেই, উত্তাপ নেই আন্দোলনেও।
বলছিলাম উত্তাপ, উষ্ণতার কথা। বিএনপি না এলেও নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৭টি অংশ নিচ্ছে। দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলে প্রার্থী আছে ১ হাজার ৮৯৬ জন। তবে সমস্যা হলো ঘুরেফিরে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রায় সবাই সরকারের অনুগত। হয় আওয়ামী লীগ মনোনীত, নয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত, নয় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। এবার নির্বাচনের যেটুকু উত্তাপ, তা ওই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরাই এনেছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ আনতে আওয়ামী লীগ এবার বিদ্রোহীদের নির্বাচনের সুযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ২০১৪ সালের মতো এআর যাতে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না পারে, সেজন্য ডামি প্রার্থীও মাঠে রাখা হয়েছে। ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ২০০ আসনের ফলাফল সবাই জেনে গেছেন। বাকি ১০০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই হবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর। অন্তত ৫০ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর হেরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হারের শঙ্কায় থাকা প্রার্থীদের ঘাম ছুটে যাচ্ছে বটে। তবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ বেশ নির্ভার। যেই জিতুক, শেষ পর্যন্ত সবাই আওয়ামী লীগেরই।
১০০ আসনে লড়াই হবে মানে, দুই-তৃতীয়াংশ আসনে কার্যত কোনো নির্বাচনী উত্তাপ নেই। রাজধানী ঢাকায় নেই নির্বাচনী আমেজ। সবখানেই একতরফা প্রচার-প্রচারণা। বাকি আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মারামারি হচ্ছে। এরই মধ্যে নির্বাচনী সহিংসতায় তিনজন মারা গেছেন। যারা মারা গেছেন, আহত হয়েছেন অনেকেই। আহত-নিহত সবাই আওয়ামী লীগেরই।
নির্বাচনী সহিংসতার সঙ্গে নির্বাচনী উত্তাপ বা উষ্ণতার কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো বিরোধও নেই। নির্বাচনী উত্তাপ আসলে উৎসবমুখরতায়, অংশগ্রহণে, প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। সেটাই বাংলাদেশ মিস করছে। নির্বাচনে একটু উষ্ণতার জন্যই সবার হাহাকার।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ