নজরুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:৫৮ এএম
আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আদর্শ নগরায়ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন

আদর্শ নগরায়ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন

এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, স্বাধীনতা-উত্তর পাঁচ দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। এ পর্যায়ে বাংলাদেশের নগরায়ণ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, ভবিষ্যতে আরও রাখবে। দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন নগরায়ণের মাত্রা, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার যে অংশ নগরবাসী, সেটি ছিল অত্যন্ত নিম্নপর্যায়ের। তখন শতকরা সাতজন মানুষ নগরে বাস করতেন। ২০২২ সালের আদমশুমারিতে বলা হচ্ছে, প্রায় ৩৩ ভাগ মানুষ নগরবাসী। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ এখন নগরবাসী। নগরায়ণের এ প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে অনেকটাই অব্যাহত থাকবে। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নগরায়ণের মূল শক্তি বা প্রক্রিয়াটি হলো, গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক জনমানুষের শহরমুখী অভিবাসন। এটার কারণ, শহরে অর্থনৈতিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। শহরের এ অর্থনৈতিক আকর্ষণকে বলা হয় জনশক্তি টেনে আনার শক্তি (‘পুল ফ্যাক্টর’)। অবশ্য একই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যমান বিকর্ষণ শক্তিও (বা পুশ ফ্যাক্টর) কার্যকর রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কারণ। নগরায়ণ নির্ভর করে সাধারণত একটা দেশের শিল্পায়নটা কীভাবে হচ্ছে তার ওপর। শিল্পায়ন অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নগরভিত্তিক হয়। যদিও গ্রামীণ ও ক্ষুদ্রশিল্পও রয়েছে, তবে বৃহৎ শিল্প, ভারী শিল্প, এগুলো নগরভিত্তিকই হয়। তেমনটি বাংলাদেশেও হয়েছে। ষাটের দশকে কিছু নগরায়ণ হয়েছে শিল্পায়নের মাধ্যমে, যেমন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা শহরে বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে ততটা শিল্পায়ন হয়নি। তবে আশির দশক থেকে শিল্পায়নের ধারা শক্তিশালী হয়েছে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টেস শিল্পের মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশক ও বর্তমান শতাব্দীর দুই দশকেও ব্যাপক শিল্পায়ন হয়েছে বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল ও চট্টগ্রামে। বর্তমানে দেশে প্রায় চার হাজার গার্মেন্টস শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তাদের বেশিরভাগই নারী। তারা অধিকাংশ গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন, সঙ্গে এসেছেন তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যরাও। তাদের মাধ্যমে ব্যাপক এবং অতিদ্রুত নগরে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে, নগরায়ণ হয়। এটাই এ দেশে সাম্প্রতিক নগরায়ণের প্রধান শক্তি। সম্প্রতি নগরাঞ্চলে অন্যান্য শিল্পও এসেছে। যেমন—সিরামিক, ওষুধ, চামড়া, ইস্পাত, আসবাব, কাচ বা গ্লাসশিল্প—এগুলোও এসেছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে শিল্পায়নটা বাংলাদেশের নগরায়ণে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা মহানগরাঞ্চল ক্রমান্বয়ে এক বৃহৎ শিল্পাঞ্চলে পরিণত হচ্ছে।

পাশাপাশি শিল্পের বাইরে যে নগরায়ণ সেটি হচ্ছে প্রশাসনিক কর্মনিযুক্তির মাধ্যমে। আর আছে সেবা খাত, যেমন—পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসেবা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পর্যটন, বিনোদন, বাণিজ্যিক অফিস, আদালত এগুলো তো আছেই।

বাংলাদেশের নগরায়ণে শ্রম নিযুক্তিতে কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক (বা ‘ফরমাল’), তবে এখনো বেশিরভাগ শ্রমিক কাজ করেন অপ্রাতিষ্ঠানিক (বা ‘ইনফরমাল’) খাতে এবং তারা স্বল্প আয়ের মানুষ। মনে করা হয়, গ্রামের তুলনায় শহরের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে আয় একটু বেশি। খুবই নিম্নস্তরের জীবনমান নিয়ে তারা টিকে থাকেন। আর টিকে থাকার জন্যই তারা শহরে আসেন। শহরে এসে কর্মসংস্থান হলেও আবাসন নিয়ে তাদের সমস্যা থেকে যায়। তা ছাড়া তাদের পরিবারের সদস্যদের মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা-পরিষেবা প্রাপ্তি খুবই কঠিন।

এরকম পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে নগরায়ণ থেকে জাতীয় অর্থনৈতিক খাতের সমৃদ্ধি হয়েছে খুবই উল্লেখযোগ্যভাবে। জাতীয় উন্নয়নে নগরায়ণের যে অবদান, নাগরিক বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান—এসবের যে সুযোগ তা বেশ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে যদিও মাত্র ৩৩ ভাগ মানুষ নগরে বাস করে, কিন্তু অর্থনীতিতে নগর খাতের অবদান প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, ৬৫ ভাগের মতো। এর মধ্যে মেগাসিটি ঢাকার একক অবদানই প্রায় ৩৫ শতাংশ। মোটা দাগে বলা যায়, অর্থনীতিতে কৃষি ও গ্রামীণ খাত যে অবদান রাখে, তার তুলনায় নগর খাতের অবদান অনেক বেশি। এজন্যই নগরায়ণকে উন্নয়নের বড় চাবিকাঠি বলা হয়।

ভবিষ্যতে জাতীয় উন্নয়নের বিষয়টি সামনে এলে নগরায়ণ খাতকেই গুরুত্ব দিতে হবে। তবে হয়তো বাংলাদেশের চিত্রটা অন্যরকমও হতে পারে। গ্রামে বা পল্লি অঞ্চলে এখনো প্রায় ৬৭ ভাগ মানুষ আছে, তাদের অবদান অর্থনীতিতে তুলনামূলকভাবে কম হলেও ভবিষ্যতে এ অবদান টিকে থাকবে। মূল অবদান কৃষির, খাদ্য উৎপাদন, ফল, সবজি—এসব শহরে উৎপাদন হবে না। মাছ-মাংস উৎপাদন ও সরবরাহ মূলত গ্রামকেন্দ্রিকই থাকবে। শহরের মানুষদের জন্য খাদ্য উৎপাদন তো করতেই হবে এবং তা হবে গ্রামেই। অবশ্য আজকাল শহরের অভ্যন্তরে ও আশপাশের প্রান্তিক এলাকায় (এমনকি অনেক বাড়ির প্রশস্ত ছাদেও) শাকশবজির বাগান গড়ে তোলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নানারকম বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি জ্ঞানের ব্যবহারে ভবিষ্যতে কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, এমন ধারণা অমূলক নয়।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের নগরায়ণের আঞ্চলিক বিন্যাসে দেখা যায়, নগর জনসংখ্যার প্রায় দুই কোটি মানুষ বৃহত্তর ঢাকা বা মেগাসিটি ঢাকা অঞ্চলে অবস্থান করছেন। এ বিন্যাসকে নগরবিদরা বলছেন, নগরের এককেন্দ্রিক উন্নয়ন। অর্থাৎ উন্নয়নটা ঢাকাকেন্দ্রিক হচ্ছে। জনসংখ্যা এখানে বিশাল। এরকম পরিস্থিতিকে ‘প্রাইমেসি’ পরিস্থিতি বলা হয়। দেশের মোট নগর জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ও দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ শুধু মেগাসিটি ঢাকায় ঘনীভূত রয়েছে। অবশ্য জিডিপিতে রাজধানী ঢাকা একাই দেশের ৩৫ শতাংশ অবদান রাখে। এই যে কেন্দ্রীভবন হয়েছে শিল্পে বা নানামুখী বিনিয়োগে, এটি বাংলাদেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এমনটা থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককেও হয়েছে। ঢাকার ক্ষেত্রে এই কেন্দ্রীভবন বেশি হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়। এখানে জনসংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে এটা তিন কোটি ছাড়াবে বলে অনেকের ধারণা।

ঢাকাকে আর এভাবে একতরফাভাবে বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়। নগরায়ণ ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ করে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরগুলোকে সুযোগ দেওয়া উচিত। জেলা শহরগুলোকে আরও শক্তিশালী করা দরকার। সার্বিকভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল উন্নত করতে হবে বিস্তৃত নগরায়ণের মাধ্যমে। নগরায়ণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে শিল্পায়ন ও সেবার মাধ্যমে। দেশের বিভাগগুলো পৌর শহর, জেলা ও উপজেলা শহরগুলো উন্নত করতে হবে। তবেই দেশে একটা ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন সম্ভব হবে। ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের উন্নতির চিন্তাও যুগপৎ ভাবতে হবে।

২০২২-এর ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি যুগান্তকারী ঘটনা। দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মোট ২১টি জেলার উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। এ রকম একটি মেগা ভৌত উন্নয়ন প্রকল্প আগেও হয়েছে, যেমন—বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতু ও অন্যান্য কয়েকটি সেতু। এ সেতুগুলোরও অবদান আছে। অতিসম্প্রতি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন হয়েছে। আরেকটি যুগান্তকারী উন্নয়ন পদক্ষেপ।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে নগরায়ণ প্রক্রিয়া ও নগরের বিশাল অবদান থাকবে, এমনটিই হবে। একসময় পুরো দেশটাই নগরায়িত হবে। তার মানে দেশের ৮০ হাজার গ্রামে যে ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, এ ব্যবস্থা যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রেখেই ভেতরে ভেতরে গ্রামের নগরায়ণ হবে। অর্থাৎ গ্রামের রাস্তাঘাট ব্যবহারযোগ্য রাখতে হবে, বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত হবে, পয়ঃব্যবস্থা, সুপেয় পানি ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, টেলিফোন বা যোগাযোগ সেবা ইত্যাদি নিশ্চিত করা হবে।

আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অনেকটাই নগরায়িত দেশ হবে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, বড় বড় ভবনে দেশটা ছেয়ে যাবে। ছোট ছোট শহরে, গ্রামেও নাগরিক সুবিধাগুলো থাকবে। গ্রামও এক অর্থে নগরায়িত হবে, তবে কৃষিজমি অক্ষুণ্ন রেখেই তা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা বা স্লোগান ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’, তথা ‘গ্রাম হবে শহর’। শিল্পাঞ্চল যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোতে নজর রাখতে হবে যাতে প্রকৃতি ও পরিবেশ সুসংরক্ষিত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। টেলিযোগাযোগের বিশাল ভূমিকা থাকবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি তথা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে হবে। সব সেবা খাতের পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে হয়। এর মাধ্যমেই ভবিষ্যতের নগর বসবাসের উপযুক্ত হবে। পরিবেশের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে মাথায় রাখতে হবে। নদী, জল, সবুজ, প্রকৃতি নিশ্চিত রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা অনুধাবন করে আমাদের দেশের গ্রাম ও নগর জনপদ সাজাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সৃজনশীল বাস্তু পরিকল্পনাবিদদের বিশাল ভূমিকা থাকবে। বলা বাহুল্য, এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত থাকবে সুশাসন ও সুব্যবস্থাপনা।

লেখক: নগরবিদ বিশেষজ্ঞ ও ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ থেকে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতিতে প্রাথমিকের শিক্ষকরা

নদীর পাড় কেটে মাটি বিক্রি, ঝুঁকিতে বাঁধ

ঈদ বোনাসের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন, সমাধান দিল সেনাবাহিনী

হজ ও ঈদের যে সিদ্ধান্তের কথা জানাল সৌদি আরব

‘মৃত্যুশয্যায়’ মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা

টেকনাফের অপহরণ চক্রের অন্যতম হোতা গ্রেপ্তার

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’, যেসব জেলায় হতে পারে ভারি বৃষ্টি

রাজবাড়ীর পদ্মাপাড়ে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক

ডব্লিউএফপির গবেষণা / বিশ্বে মাত্র একটি দেশই খাদ্যে শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ

জুনে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে ইউরোপের এক দেশ

১০

ঢাকার বাতাস সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’

১১

আজ কেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া 

১২

গাজায় স্কুলে বোমাবর্ষণ  / যুদ্ধ বন্ধে ইউরোপ ও আরব দেশগুলোর আহ্বান

১৩

পদ্মার চরে কৃষকদের পিটিয়ে গরু জবাই করে পিকনিক

১৪

দুপুরের মধ্যে ১৬ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১৫

২৬ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

ঈদযাত্রায় ট্রেনের ৫ জুনের টিকিট মিলছে আজ

১৭

২৬ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৮

পরমাণু অস্ত্রভান্ডারকে আধুনিকীকরণ করছে পাকিস্তান, দাবি মার্কিন গোয়েন্দাদের

১৯

তৃতীয়বারের মতো লাহোরের পিএসএল শিরোপা জয়

২০
X