ইসরায়েল আজ পুরো ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর বর্বর প্রতিশোধ নিচ্ছে। হামাসের হামলার জবাবে একই দিন ফিলিস্তিনের গাজায় পাল্টা হামলা শুরু করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী। প্রায় তিন মাস ধরে চলা এই নির্বিচার হামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় এরই মধ্যে গাজায় ২৫ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১৯ লাখের অধিক ফিলিস্তিনি। চলমান এ আগ্রাসনে সেখানকার নিহতদের অধিকাংশই নিরীহ শিশু ও নারী। পুরো বিশ্বের মধ্যে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকাই একমাত্র দেশ, যারা ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান এ বর্বরতার দায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। গাজা সংকট মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য সংকটের দুয়ার খুলে দিয়েছে—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মধ্যপ্রাচ্যে যখন একটি অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হুতিদের ওপর একের পর এক হামলা অব্যাহত রেখেছে। ফলে লোহিত সাগরে নৌ-চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ইরান-সমর্থিত হুতিরা বিভিন্নভাবে গাজা যুদ্ধের সুযোগ নিচ্ছে। আর এভাবেই লোহিত সাগর হয়ে উঠছে মার্কিন ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষের ক্ষেত্র। এসব যেন যথেষ্ট নয়। তাই সম্প্রতি দায়েশ ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানির স্মরণে একটি অনুষ্ঠানে হামলা চালায়। উল্লেখ্য, কুদুস সোলাইমানি ২০২০ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। যাই হোক, ইরান এ হামলার কড়া জবাব দেয়। তারা ইরবিলে অবস্থিত একজন কুর্দি ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে দাবি করে যে, এটি একটি ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তি কেন্দ্র। তারা উত্তর সিরিয়ার ইদলিবের একটি মেডিকেল ক্লিনিকেও হামলা করে।
এ সমস্ত ঘটনা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। কারণ, দায়েশ এমন একটি সংগঠন, যার নির্মূল বা ধ্বংস চায় ট্রান্সআটলান্টিক সম্প্রদায়। সেই দায়েশ ট্রান্সআটলান্টিক সম্প্রদায়ের শত্রুদেশগুলোর ওপর আক্রমণ করেছে—এ ঘটনাটি পুরো পরিস্থিতিতে এক ধরনের রহস্যাবৃত করে বইকি। এভাবে এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি আরও বাড়ছে। অবস্থা এমন যে, এই অঞ্চলে কে যে কার শত্রু, তা কেউ জানে না।
এসব সংকটের মধ্যে চাপা পড়েছে তুরস্ক। অথবা বলা যায় সংকটে জর্জরিত এখন তুরস্ক। প্রথমেই বলা যায় যে, তারা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে লড়াই করছে, ভয়ের সঙ্গে নয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরও পরিশীলিত ব্যবস্থা ও কৌশল প্রয়োজন। তুরস্ক তার সীমানার বাইরে গিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ফলে তাদের কার্যকর পদক্ষেপের স্বাধীনতা স্বাভাবিকভাবেই সীমিত হয়েছে। কারণ তারা এখন সিরিয়া ও ইরাকে একটি প্রতিকূল পরিবেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। তুর্কি-ইরাকি সীমান্তে সাম্প্রতিক হামলায় এক ডজনেরও বেশি তুরস্কের সেনা নিহত হয়েছে। কুর্দিদের এমন একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবশ্যই কোনো অত্যাধুনিক দেশ সহায়তা করেছে বলেই ধারণা করা যায়। আমার মনে হয়, এমন পরিস্থিতিতে তুরস্ককে তার কৌশল পুনর্বিবেচনা করার দিকেই ধাবিত করবে।
দুই ন্যাটো মিত্র তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন একে অন্যের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ বা বৈরী সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে। একটি ইস্যু তাদের মধ্যে উভয় সংকটের সৃষ্টি করেছে, তা হচ্ছে, ন্যাটো যদি কোনো সামরিক সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়, তবে এই দুই মিত্র কীভাবে একই অবস্থায় থেকে তার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এমন অবস্থায় আমি মনে করি, তারা যদি সব বিষয়ে একমত নাও হয়, তাহলেও তুরস্ক ও ওয়াশিংটনের উচিত দুই ন্যাটো মিত্র হিসেবে একটি কার্যকরী কাঠামো গড়ে তোলা। এ উদ্দেশ্যে তাদের উচিত মাঝামাঝি কোথাও মিলিত হওয়া এবং একটি ফলপ্রসূ আলোচনা করা। যদিও এখন পর্যন্ত এমনটি হয়নি।
তুরস্কের নিজেরই কিছু সংকট রয়েছে এটা বাস্তব। তবে এই অঞ্চলে অনেক স্টেকহোল্ডার রয়েছে, যাদের একত্রিত করার ক্ষেত্রে দেশটির বেশ কিছু সুবিধাও রয়েছে। রাশিয়া, ইরাক, সিরিয়া এবং ইরানের মতো এই অঞ্চলে প্রভাবশালী অন্য দেশগুলোও এ ধরনের পদক্ষেপ ও সহযোগিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে।
কুর্দি সমস্যা এই অঞ্চলের জন্য আরেকটি বড় মাথাব্যথা। রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিতে বিপরীত শিবিরে অবস্থান করলেও তারা কিন্তু উভয়েই কুর্দিদের সমর্থন করে। সিরিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বহুবার আলোচনা করে মস্কো বারবার কুর্দি যোদ্ধাদের সিরিয়ার জাতীয় সেনাবাহিনীতে একটি পৃথক ব্রিগেড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। আবার এদিকে একই ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বে সিরিয়ার ভূখণ্ডে একটি কুর্দি-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল তৈরি করার চেষ্টা করছে বহুদিন ধরে।
ইরাক এবং সিরিয়া—এই দুটি দেশ থেকে উদ্ভূত সন্ত্রাসের অবসান ঘটানোকেই তুরস্ক একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দেশটি কয়েক দশক ধরেই এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে বাস্তবে তার ফলপ্রসূ প্রভাব খুব একটা স্পষ্ট নয়। যদিও এই কাজটি মার্কিন সহযোগিতা ছাড়াও সম্পন্ন করা সম্ভব, তথাপি এটি তাদের সহযোগিতা ছাড়া করা কঠিন হয়ে পড়েছে তুরস্কের জন্য।
তুরস্ক তাদের ভূখণ্ড থেকে সন্ত্রাসের ফোকাস সিরিয়া ও ইরাকে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে—এটাও সত্য। তবে এটিই তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। এখন তুরস্কের উচিত হবে এই দেশগুলোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা করা এবং তাদের আরও সহযোগিতা বাড়িয়ে দেওয়া, যাতে করে সন্ত্রাস মোকাবিলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হচ্ছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা। তারা ইসরায়েলকে তাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রধান স্তম্ভ বলে বিবেচনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি এই সমর্থন বাদ দিতে পারে—এমন কোনো লক্ষণ আপাতত নেই। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিনপন্থি পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
যদি তুরস্ক একটি সুন্নি অধ্যুষিত দেশ না হতো, তবে তারা সুন্নি ও শিয়া বিশ্বের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু আঙ্কারার বর্তমান সরকার এমন ভূমিকা গ্রহণ করা থেকে যে অনেক দূর—তা বলাই বাহুল্য।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি-সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার দিক হলো, লোহিত সাগর এবং বাব-এল-মান্দেব প্রণালিতে নতুন দাবানল বা উত্তেজনা। এই অঞ্চলে পরিস্থিতি যখনই অনিশ্চিত, উত্তপ্ত বা অস্থির হয়ে ওঠে, তখনই ইরান সে সুযোগটি নেয়। তারা ইয়েমেনে প্রচ্ছন্নভাবে হুতিদের পক্ষাবলম্বন বা তাদের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় এ সুযোগটি ব্যবহার করে। সুতরাং, এ পরিস্থিতিকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না রাখতে পারলে, এটি এ অঞ্চলের অন্যান্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং সুয়েজ খালে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য এখন বহু সংকটে পূর্ণ বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক: তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দেশটির ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। নিবন্ধটি আরব নিউজ থেকে ঈষৎ অনুবাদ করেছেন সঞ্জয় হালদার