কমলা ভট্টাচার্য বিশ্বের প্রথম নারী ভাষাশহীদ। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৬১ সালে আসামে যে ১১ জন প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের একজন হলেন কমলা ভট্টাচার্য। বায়ান্নর পর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ভারতের আসামে বরাক উপত্যকায় প্রাণ দিতে হয়েছে যথাক্রমে ১৯৬১ সালের ১৯ মে, ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই তারিখে। এরপর ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা’র মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন সুদেষ্ণা সিংহ। তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ভাষাশহীদ।
কমলা ভট্টাচার্য ১৯৪৫ সালে সিলেটের শ্রীহট্টে জন্মগ্রহণ করেন। রামরমণ ভট্টাচার্য ও সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের পঞ্চম সন্তান। কমলারা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন। চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবেই তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটতে থাকে কমলার পরিবারের। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় গণভোটের মাধ্যমে আসামের শ্রীহট্টসিলেট (শ্রীহট্ট) জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কমলারা পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সার্বিক গণহত্যা শুরু হলে তার রেশ সিলেটেও (শ্রীহট্টে) এসে পড়ে। কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে আসামে চলে যেতে বাধ্য হয়। তারা সিলেটের (শ্রীহট্ট) পার্শ্ববর্তী আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নেন।
শিলচরে কমলারা থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে। কমলার বড়দিদি বেণু নার্সের চাকরি পেয়ে শিমুলগুড়ি চলে যান প্রশিক্ষণ নিতে। কমলার মেজদিদি প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। কমলার পরিবার তার মেজদিদির আয়ের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। শৈশবে কমলা ভর্তি হন শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটে। কিন্তু স্কুলের পাঠ্যপুস্তক কেনার ক্ষমতা ছিল না কমলার। কমলা একবার বড়দিদি বেণুকে একটি অভিধান কিনে দিতে বললে তিনি সেটা কিনে দিতে পারেননি। কমলা তার সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার করে তার বিষয়বস্তু খাতায় টুকে নিতেন। ১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসেন। তার ইচ্ছা ছিল পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি স্নাতক পর্যন্ত পড়বেন। ম্যাট্রিকের পর তিনি টাইপরাইটিং শিখবেন বলে মনস্থির করেন। এমন একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ১৯৬১ সালে কমলা ভট্টাচার্য ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে সর্বাত্মক
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ‘কাছাড় গণসংগ্রাম
পরিষদ’-এর
আহ্বানে সেই বছরের ১৯ মে হরতাল পালনের ঘোষণা করা হয়। ম্যাট্রিকুলেশন
পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরদিন সকালে কমলা তার মেজদিদি প্রতিভার স্কুলে যাওয়ার জন্য রাখা শাড়ি আর ব্লাউজ পরেই এগারো বছর বয়সী ছোট বোন মঙ্গলাকে সঙ্গে নিয়ে শিলচর রেলস্টেশনের সেই প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে যোগ দেন। তাদের ঘরে কোনো খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় আন্দোলনে বেরিয়ে পড়েন কমলা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জন্য তিনি মায়ের কাছ থেকে একটুকরো কাপড় চেয়ে নিয়েছিলেন। সেদিন দুপুর পর্যন্ত প্রায় শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারীদের রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। কিন্তু দুপুরের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অতর্কিতভাবে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত শান্তিপূর্ণ অবরোধকারীদের ওপর উপর্যুপরি লাঠিচার্জ এবং আটক করতে শুরু করে। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপে অবরোধকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটতে শুরু করে। পুলিশ সদস্যদের লাঠিচার্জে কমলা ভট্টাচার্যের ছোট বোন মঙ্গলা গুরুতর আহত হন। সেই সময় কমলা ছুটে গিয়ে মঙ্গলাকে সাহায্যের চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে পুলিশ সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। একটি গুলি এসে কমলার চোখ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সেই সময় আরও অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন, অন্য আহতদের সঙ্গে কমলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
লেখক : সহকারী সম্পাদক
দৈনিক কালবেলা