প্রতিবছর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যবইয়ে ভুল হবে এবং সংশোধনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে—এটি যেন অনিবার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। অথচ প্রতিটি বইয়ের জন্য রয়েছে লেখক-সম্পাদক। এরপর বই প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয় একাধিক বিশেষজ্ঞের কাছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে বই মূল্যায়নের একাধিক বিকল্পের কথা জানা যায়। এতকিছুর পর এবারও পাঠ্যবইয়ে ভুলের ব্যত্যয় ঘটেনি। শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ অবজ্ঞা অত্যন্ত দুঃখজনক।
শনিবার কালবেলায় প্রকাশিত ‘পাঠ্যবইয়ে এবারও ভুলের ছড়াছড়ি’ শীর্ষক শিরোনামে এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা নির্দ্বিধায় হতাশার। প্রতিবেদন অনুসারে, এবারও পাঠ্যবইয়ে শতাধিক ভুল পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভুলের সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হওয়া বিভিন্ন সাইট বা ব্লগ থেকে কপি করার প্রবণতাও বাদ যায়নি। এ ছাড়া মলাটে এক শ্রেণি এবং ভেতরে অন্য শ্রেণির বই লেখা হয়েছে বলেও অভিযোগ এসেছে। গত বছর থেকে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই যায়। চলতি বছর গেছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই। এসব বইয়ের মধ্যে বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ে ভুলের পরিমাণ বেশি। এ বিষয়ে বরাবরের মতোই এনসিটিবি ভুল যাচাই করে সংশোধন করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
বইগুলোতে অতি সাধারণ বানান ভুল, সাধারণ বাক্য গঠনে অসংগতি, লেখকের নামের অনুপস্থিতি, লেখকের মৃত্যুর একাধিক সাল, ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিভ্রাটসহ বেশিরভাগ ভুল খুবই বিস্ময়কর। অর্থাৎ ভুল দেখে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এর পেছনে চূড়ান্ত পর্যায়ের অবেহেলা আর উদাসীনতা না থাকলে এমনটা হওয়া অসম্ভব। যেমন—সহযোগিতাকে ‘সহযোগীতা’, সুস্থকে সুস্থ্য, ঝুঁকিকে ঝুঁকী, কিলোমিটারকে কীলোমিটার এবং ‘পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’—বাক্যটি ১৫ বার ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ বারই ‘পৃখিবী’ লেখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানিক, পাকিস্তানকে লেখা হয়েছে পকিস্তান। ণত্ববিধান ও ষত্ববিধান না মেনে ‘ভাতখণ্ড’কে লেখা হয়েছে ‘ভাতখন্ড’ ইত্যাদি। এই কয়েকটি উদাহরণ কি সংশ্লিষ্টদের দায়সারা কাজের সাক্ষ্য দেয় না?
গত বছর এনসিটিবি প্রবর্তিত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে সব মিলিয়ে পৌনে ৭০০ ভুল ধরা পড়ে। এরপর আমরা দেখেছি দেশব্যাপী কী পরিমাণে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেয় সেই ঘটনা এবং বিভিন্নভাবে বিদ্রুপের শিকার হতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ থেকে কি তারা কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেননি?
আমরা জানি, গাইড বই ছুড়ে ফেলে, কোচিং সেন্টার বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভর পড়ালেখা থেকে বের করে আনার নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকারের এ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তারাই আবার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে কোচিং সেন্টারের ম্যাটেরিয়ালস, ব্লগ থেকে সরাসরি কপি করে অর্থাৎ চুরি করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। গত বছর এমন একটি ঘটনায় সমালোচনার একপর্যায়ে দায় স্বীকার করতে হয় প্রতিষ্ঠানটির।
আমরা মনে করি, শিক্ষা নিয়ে এই অবজ্ঞা ও উদাসীনতা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান শুধু এর সংশোধন ও পুনরায় সারা দেশে বই পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করলেই দায় শেষ হয়ে যায় না। এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু জড়িত। তাদের অন্যতম অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন। ভুলের যে পরিমাণ, তা সংশোধনে যে বিরাট অঙ্কের টাকা খরচ হবে, সেটিও বিশেষভাবে বিবেচ্য। আমাদের প্রত্যাশা, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক ও সতর্ক হবেন। পাশাপাশি এসব ভুল ও অসংগতির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।