জাকির হোসেন
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫১ এএম
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিরোধ দিবসের ডাক

প্রতিরোধ দিবসের ডাক

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বারুদের গন্ধমাখা স্মৃতিবিজড়িত একটি অগ্নিঝরা দিন। ১৯৮৩ সালের এই দিনে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সূচিত হয় বড় ধরনের আন্দোলন, যা মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। সেই থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এ দেশের ছাত্রসমাজ দিনটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছিল। তবে আন্দোলনের এক দশক পার না হতেই এ দেশের মানুষের কাছে বিস্মৃত হতে থাকে জয়নাল, জাফর ও দিপালী সাহার নাম।

ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের প্রভাবে আড়াল হতে শুরু করে রক্তের অক্ষরে লেখা এক গৌরবময় সংগ্রামের ঐতিহাসিক দিন। ১৯৯৩ সালের দিকে সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’-এর সম্পাদক শফিক রেহমানের উদ্যোগে দিনটি পরিণত হয়েছে ভ্যালেন্টাইন ডে এবং বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে। পাশ্চাত্যের রীতিনীতিতে ছিলেন অভ্যস্ত শফিক রেহমান। যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরে তিনি এ দেশে ভালোবাসা দিবসের প্রচলন করেন। এর এক যুগ পর তিনি তার তেজগাঁওয়ের দৈনিক যায়যায়দিন অফিসের সামনের রাস্তাটির নাম দেন ‘লাভ রোড’। ভালোবাসা দিবস নিয়ে অনেক ধরনের মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত শফিক রেহমানের চিন্তাটি নতুন প্রজন্মকে বেশি আকর্ষণ করে। সেইসঙ্গে এ দেশে প্রেমের একটা নতুন বাজার তৈরি হয়েছে, হাজার হাজার কার্ড, ঘড়ি থেকে হীরা বিক্রি হচ্ছে, মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডাররা এসএমএস থেকে দুই পয়সা তুলছে, টেলিভিশনে এমন একটা ভাব যে ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে দেশে একেবারে ঈদের মতো আমোদ হচ্ছে। ভ্যালেন্টাইন ডে’র প্রভাবে নতুন প্রজন্ম জানতে ও বুঝতে পারছে না ফাল্গুনের এই আগুনঝরা দিনের সঙ্গে মিশে আছে ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহার লাল টকটকে রক্ত, আত্মত্যাগের এক সংগ্রামী ইতিহাস।

১৯৮৩ সালের এই দিন মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জয়নাল, জাফর, দিপালী সাহাসহ অনেকে। লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এরপর প্রায় এক বছর ধরে চলে আন্দোলনের প্রস্তুতি। ১৯৮২ সালে শিক্ষা দিবস (১৭ সেপ্টেম্বর) সামনে রেখে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৬ সেপ্টেম্বর মৌন মিছিল করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র ঐক্য ফোরামসহ কয়েকটি সংগঠন। এরপর ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর উপলক্ষে পরদিন (৮ নভেম্বর) বিক্ষোভ মিছিল করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পুলিশ এ মিছিলের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় এবং লাঠিচার্জ করে। ফলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের তীব্র সংঘর্ষ বাধে এবং এ সংঘর্ষ কয়েক ঘণ্টা চলে। পুলিশ একপর্যায়ে কলাভবনের ভেতরে ঢুকে ছাত্র ও শিক্ষকদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায়। এতে অনেক ছাত্রছাত্রী ও কয়েক শিক্ষক আহত হন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৮ নভেম্বর ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ঐক্য আরও দৃঢ় হয় এবং ১৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর ১৩ ডিসেম্বর এ সংগঠন বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচির ডাক দেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদের উপদেষ্টা মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়া হয়। এ কর্মসূচি সফল করতে ছাত্রদের একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল সকাল ১১টার দিকে শিক্ষা ভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশ বাধা দেয়। ফলে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন জয়নাল, জাফর, দিপালী সাহাসহ কয়েকজন। নিহতদের কয়েকজনের লাশ গুম করে সরকার। বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। একই সঙ্গে ওই সময় পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় এবং বিপুলসংখ্যক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। ছাত্রহত্যা ও পুলিশি হামলার প্রদিবাদে পরদিন এ আন্দোলন জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দাবালনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলে সংবাদপত্রের ওপর এতই নিষেধাজ্ঞা ছিল যে, এই বিক্ষোভ এবং ছাত্রহত্যার ঘটনার বিষয়ে পরদিন কোনো পত্রিকায় সরকারের প্রেস নোটের বাইরে অন্য কোনো খবর প্রকাশ করতে পারেনি।

রক্তাক্ত ১৪ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট: এইচ এম এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখলের পর সামরিক শাসন জারির দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে পোস্টার লাগাতে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর তিন সদস্য গ্রেপ্তার হন। এই ছাত্রনেতারা হলেন শিবলী কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আবদুল আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। সেই থেকে শুরু হয় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপসহীন লড়াই।

বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে শহীদবেদিতেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। মিছিলের খবর শুনে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী চলে আসে, স্মৃতিসৌধে ছাত্রদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। সরকারি ফরমান ও তৎপরতার কারণে সে সময় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লাল-কালো অক্ষরে এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দেয়াল লিখন অব্যাহত থাকে। ছাত্রদের দেয়াল লিখন সমানে মুছতে থাকে সামরিক সরকারের তল্পিবাহক পুলিশ বাহিনী। পুলিশ যত দেয়াল সাদা চুন দিয়ে মুছে ফেলে, ছাত্ররা ততই দেয়াল লিখন চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে চলছিল দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের প্রাথমিক প্রস্তুতি। এ সময় ছাত্রনেতারা একটি সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করে। সেটাই ছিল সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম লিখিত প্রতিবাদ।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অভিনেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায় আর নেই

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাবার ছবি দেখিয়ে আফ্রিদির জামিন চাইলেন আইনজীবী

যুক্তরাজ্যে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত

আইনজীবী আলিফ হত্যা মামলায় ৩৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ

গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলের হামলা, সাংবাদিকদের দেখেই ফেলল বোমা

খুলনার নতুন ডিসি তৌফিকুর রহমান

চট্টগ্রামে আর এ কে সিরামিক্স ফ্যাক্টরির আউটলেট উদ্বোধন 

৩৪ পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি

ডাকসু নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন ২১ প্রার্থী

কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় ৫ জনের যাবজ্জীবন

১০

জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আটক

১১

কাজলকে জুম করে অস্বস্তিকরভাবে ক্যামেরাবন্দি, ক্ষোভ মিনি মাথুরের

১২

মানবদেহে বিশ্বের প্রথম মাংসখেকো মাছি শনাক্ত

১৩

টেকনাফের সাবেক চেয়ারম্যান জাফরের স্ত্রীর কারাদণ্ড

১৪

ডেঙ্গুতে আরও ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪১২

১৫

সারা দেশে একযোগে ৫৩ বিচারককে বদলি

১৬

‘রুমিন ফারহানাসহ সব নারীর প্রতি স্লাট-শেমিংয়ের বিরুদ্ধে আমার স্পষ্ট অবস্থান’

১৭

ফল প্রকাশের দাবিতে রাবির আরবি বিভাগে শিক্ষার্থীদের তালা

১৮

খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা : বুলু

১৯

সমুদ্রে পর্যটকদের জন্য জরুরি নির্দেশনা

২০
X