ইস্ট এশিয়া ফোরাম এডিটোরিয়াল বোর্ড ক্রফোর্ড স্কুল অব পাবলিক পলিসি এবং কলেজ অব এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক রূপে বিবেচিত। গত ৫ ফেব্রুয়ারি এ ফোরামের পক্ষ থেকে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি ঈষৎ ভাষান্তর করেছেন গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
মিয়ানমারে চলমান সংঘাত নিরসনের বিষয়ে কারও কাছে কোনো সুখবর নেই। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘটা সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। তারপরও পূর্ব থেকে গৃহযুদ্ধপীড়িত দেশটির সমাজ এবং অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক এ সংঘাত বিধ্বংসী প্রভাব ফেলে চলেছে।
তবে ২০২৩ সালে যুদ্ধের তীব্রতায় এক ধরনের স্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়। এমন ইঙ্গিতকে একটি উৎসাহজনক দিক বা আশার আলো বলে বিবেচনা করা হয়েছিল। এ সময় সরকার ও সামরিক জান্তাবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অপ্রত্যাশিত ঐক্যের ফলে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) তথা সামরিক জান্তার বাহিনী সিরিজ পরাজয় মানতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরোধী শিবিরের সর্বাত্মক প্রতিরোধের এ অগ্রগতি ও সাফল্য দেশের সামরিক বাহিনীর মুখে অপমানের কালিমা মেখে দিয়েছে, যা উচ্চপদমর্যাদাধারী সামরিক কর্মকর্তা এবং সাধারণ সৈনিকদের মনোবলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ জয়-পরাজয় দেশের অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই শুধু ক্ষমতার ভারসাম্য ধরে রাখার অতি প্রাচীন প্রবণতাকে অস্থিতিশীল ও প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। সমাজবিজ্ঞানের গবেষক ও অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিকোলাস ফ্যারেলি এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, দেশের রাজধানী নেপিদো মহানগরীতে থাকা সামরিক জেনারেলরা এখন আগের চেয়ে বেশি চাপ বোধ করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এরপর কী ঘটবে, এমন প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা বা প্রশ্ন শুরু হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে প্রশ্নটি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ প্রশ্নের পাশাপাশি আরও কিছু উত্থাপিত প্রশ্নের একটি হলো সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা ক্ষমতাসীন জাতীয় ঐক্য সরকার তথা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) আওতায় থেকে জান্তাবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে কী ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব, যেখানে সেনা অভ্যুত্থানের সময় ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিত বেসামরিক রাজনীতিবিদদেরও সরকার রয়েছে এবং বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী কয়েক দশক ধরে কেন্দ্রীয় রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে।
অধ্যাপক ফ্যারেলি লিখেছেন, যদি সামরিক শাসন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় অর্থাৎ সেনা অভ্যুত্থানকারীদের পিঠ যদি দেয়ালে ঠেকেও যায়, তবুও মিয়ানমারের জনগণের কঠোর সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। উল্লেখ্য, জাতিগত, ধর্মীয় এবং আদর্শিক কারণে যারা সংগ্রাম করে, তারা প্রায়ই এমন সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।
সেনা অভ্যুত্থানের তৃতীয় বার্ষিকীর প্রাক্কালে, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) প্রধান জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যা সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রণীত ২০০৮ সালের সংবিধানে নিহিত সীমাবদ্ধ গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তার পরিবর্তে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ফেডারেল রাষ্ট্রের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এ রূপরেখায় সামরিক বাহিনীর কোনো ভেটো ক্ষমতা থাকবে না এবং সেনাবাহিনী কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে না।
যারা এ ধরনের একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেন এবং গভীর রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ, তাদের সতর্ক করে দিয়ে অধ্যাপক ফ্যারেলি বলেন যে, কোনো একটি দিনের শেষে বা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘যদি সংঘাত বন্ধ হয়ে যায়’, তখন অগণিত গোষ্ঠীর মধ্যে সুষমভাবে ক্ষমতা এবং সম্পদ ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ অভ্যুত্থানকারী সেনা ও তাদের দোসরদের পরাজিত করার জন্য সবাই কঠোর লড়াই করেছেন। তারা বোধগম্যভাবে কর্তৃত্বের ক্ষেত্র তৈরি করতে, স্বায়ত্তশাসিত সরকারের সঙ্গে নিজেদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে এবং দেশের বিশাল সম্পদের একটি অংশ নিজেদের অধীনে সুরক্ষিত করতে আগ্রহী।
বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে এখনো অনেক রক্তপাত বাকি। সরকারবিরোধী প্রতিরোধ বাহিনী এখনো পর্যন্ত প্রতিরোধ করে চলেছে। তবুও প্রতিরোধ বাহিনী আশা করবে যে, সামরিক অবস্থানের আরও অবনতি ঘটলে জান্তারা যেন ন্যাশনাল ইউনাইটেড গভর্নমেন্ট (এনইউজি) এবং তার মিত্রদের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হয়। এতে ব্যর্থ হলে ভূখণ্ড এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও জান্তার ক্ষমতাকে সামরিক কায়দায় ধ্বংস করার জন্য প্রতিরোধ বাহিনী পরিচালিত একটি নৃশংস লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এটাই হতে পারে রাজধানী ‘নেপিদোর’ মহানগর পতনের দৃশ্যপট। যেমন অধ্যাপক ফ্যারেলি লিখেছেন, ‘বর্তমান সামরিক নেতৃত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে এমন একটি সমঝোতা মীমাংসার কল্পনা করা কঠিন। যদি নেপিদো আক্রমণ করা হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দখল সম্ভব হয়, তবে সরকার ও সেনাদের শেষ বিকল্প হবে অসম্মানজনকভাবে অভয়ারণ্যে নির্বাসনে গমন।
তামাদাও (তাঁতমাদও) নামে পরিচিত মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিদ্রোহীদের পাশাপাশি বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণ করার পদ্ধতি অবলম্বন করে, যাতে সব সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত করা যায় এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করা যায়। যদি স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের পতন ঘটে, তাহলে সংঘাত-পরবর্তী পরিস্থিতিতে জবাবদিহিতা এবং নৃশংসতার জন্য দায়মুক্তির প্রশ্নগুলো বড় আকার ধারণ করবে। কারণ সংঘর্ষ-পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা যা-ই হোক না কেন, সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খর্ব হবে না বরং তারাই শক্তিশালী রাজনৈতিক খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারে। যাই হোক না কেন, ক্ষমতার শূন্যতা রোধ এবং মিয়ানমারকে যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া থেকে ফিরে আসা এবং তার ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমার স্থায়িত্ব রোধ করাকে সবার ওপরে অগ্রাধিকার দিয়ে কঠোর রাজনৈতিক সমঝোতা করতে হবে।
স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল পরবর্তী সরকারের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমন্বয় করার সক্ষমতা রয়েছে বলে ধরে নিলেও মিয়ানমারকে আবার ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে নতুন সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রচুর কাজ করতে হবে। কভিড-১৯ মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যাকে এ সংঘাত শুধু অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করেনি, সেইসঙ্গে সংঘাতের ফলে সামাজিক কাঠামো বা সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে গেছে। আইন ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার কাউন্সিলের যুগে নজরদারি, নালিশ করা, নির্বিচারে আটক এবং নির্যাতন প্রতিদিনের কাজের সমার্থক ছিল।
একই পরিস্থিতি পরবর্তী সময়ে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের অধীনে থাকা রাজ্য বা অঞ্চলগুলোতে বিরাজমান। সেইসঙ্গে সামাজিক আস্থার সংকট ও সংহতির দুর্বলতাও লক্ষণীয়। মিয়ানমারের গৃহসংঘাত এখন আর সেরকম নিয়ন্ত্রণের বাইরে বা অচলাবস্থায় নেই, যা মাত্র এক বছর আগেও দেখা গিয়েছিল। আসিয়ানকে অবশ্যই জান্তাকে বোঝানোর জন্য প্রতিটি সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে ২০২১ সালে স্বাক্ষরিত ‘পাঁচ দফা ঐকমত্য’ বাস্তবায়নের সঙ্গে আসিয়ান যে জড়িত এবং বিশেষভাবে আগ্রহী, তা জানাতে হবে। আসিয়ান হলো প্রতিরোধ বা বিদ্রোহী বাহিনী ও সামরিক জান্তাদের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার সুস্পষ্ট প্ল্যাটফর্ম। আসিয়ানের এমন ভূমিকা গ্রহণ পশ্চিমা স্টেকহোল্ডাররাও সাদরে গ্রহণ ও সমর্থন করবে।
আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা স্পষ্ট নয়। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান ও লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক এনজে হান মনে করেন যে, চীন মিয়ানমারের ক্ষেত্রে দুদিকেই বাজি ধরেছে। একদিকে চীন স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আবার অন্যদিকে মিয়ানমারের সীমান্তে সক্রিয় কিছু প্রতিরোধ বা বিপ্লবী গোষ্ঠীকে স্পষ্টতই সমর্থন দিচ্ছে। চীন ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) সম্পর্কে সতর্ক রয়েছে। কারণ চীন এনইউজিকে পশ্চিমাদের খুব কাছাকাছি মনে করে। তবে রাজনীতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রে চীন মিয়ানমারের স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলকে কী পরিমাণ নিরাপত্তা বা আশ্রয় দেবে, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। কারণ সামরিক জান্তার ভাগ্য দেয়ালে লেখা থাকে না।
ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের জড়িত হওয়ার ব্যস্ততার সঙ্গে মিয়ানমারের তুলনা করলে দেখা যায়, কূটনৈতিক অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে মিয়ানমার পিছিয়ে আছে; কিন্তু আসিয়ানের ভবিষ্যৎ মিয়ানমারের এ মর্মান্তিক সংঘাতের সমাধানের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এশিয়ার এ অঞ্চলে সমস্যার সমাধানে সাফল্য কিংবা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে এমন সংঘাতের ক্যান্সারতুল্য প্রভাব এড়াতে আসিয়ানের দক্ষতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের বিষয়ে একটি উদ্যোগের জন্য প্রস্তুতি কূটনৈতিক বিবেচনায় আসিয়ানের জন্য অতি আবশ্যিক।