ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০২:২৮ এএম
আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০৮:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার মান নিয়ে যত কথা

শিক্ষার মান নিয়ে যত কথা

শিক্ষা জীবনের শুরুটাই প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে, প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হয়ে মাধ্যমিক, তারপর উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সামর্থ্য ও সুযোগ সবার জুটে না, আবার কেউ কেউ প্রাথমিক শিক্ষাজীবনের শেষ মুহূর্তে আর্থিক ও পারিবারিক সীমাবদ্ধতার জন্যে পড়ালেখা করতে পারে না। শিক্ষা লাভের অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। এই অধিকার প্রতিটি শিশুর ও নাগরিকের জন্য সমভাবে লাভ করার সুযোগ সৃষ্টি এবং এর ক্ষেত্রটা তৈরি করার দায়িত্ব সরকারের। শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের যে অধিকার, তা দিতে হবে। এই ধারণা সামনে রেখে পাশ্চাত্যের দেশসমূহে উনিশ শতকের শেষভাগে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে জাপান উনিশ শতকেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভের নানা উদ্যোগ হাতে নেয় এবং তা কার্যকর করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক যে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা এবং ১৯৫৯ সালে যে শিশু অধিকারের ঘোষণা গৃহীত হয় তাতে প্রতিটি শিশুরা শিক্ষা লাভের অধিকার এবং তা যথাযথ বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়। এই দুটি ঘোষণাতেই প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

বুনিয়াদি শিক্ষা একটি দেশের উন্নতি, অগ্রগতির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন, শুধু প্রতিটি শিশুর মানবিক গুণাবলিকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা নয়। প্রাথমিক শিক্ষা একজন শিশুকে শুধু যোগ-বিয়োগ, ভাষাজ্ঞান নয় বরং শিশুর মানসিক বিকাশ বুদ্ধি বিচারের ক্ষমতা, মাঠেÑময়দানে, কলকারখানায় দক্ষকর্মী বাহিনীতে পরিণত করার ক্ষেত্রেও প্রাথমিক শিক্ষা নানাভাবে সহযোগিতা এবং দক্ষতার জন্ম দেয়। আবার মানুষের উদ্যমশীলতা আনয়ন এবং মৌলিক চাহিদা-পুষ্টি, আশ্রয়, পোশাক, স্বাস্থ্যসেবা এসব কিছু মেটাতেও প্রাথমিক শিক্ষা মানুষকে সহযোগিতা করে। যার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক যে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা হয় তাতে শিশুকে বাধ্যতামূলক এবং প্রতিটি নাগরিকের অধিকার হিসাবে ঘোষণা করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয়েছে। একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে সমাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রেখে সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের সুযোগ করবে সরকার।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই কাজটি করা হয়নি সুন্দরভাবে। সর্বজনীন শিশু শিক্ষার কথা বলা হলেও একই দেশে বসবাসরত একই ভাষাভাষী, স্বাধীন দেশের নাগরিকরা আজ নানামুখী শিশু শিক্ষা গ্রহণ করে বড় হচ্ছে। এতে নানামুখী চিন্তার প্রসারের কারণে দেশে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে, যা কোনোক্রমেই একটি দেশের জন্য শ্রেয় নয়। দেশে সর্বজনীন শিশুশিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য মাঝে মাঝে দারুণ মায়াকান্না আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বটে, তবে তা কতটুকু ফলপ্রসূ এবং কার্যকরী হয়েছে, তা বলার সময় এসে গেছে। স্বাধীন দেশের মানুষ দেশের মধ্যে যে পরাধীন আছে। স্বাধীনতার কথাই ছিল বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। এটা আদৌ কার্যকর হয়েছে কি না? এই প্রশ্নের উত্তর এখন আমাদের জানতে হবে। জানার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের যেমন আছে, যে কোনো সরকার তা জানতেও বাধ্য।

বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষাকে আধুনিক করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, সেই অনুযায়ী কিছু কিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন। যার পথ ধরে প্রণীত হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯। এটি ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতির আদলে রচিত তবে আধুনিক ও আজকের সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রণীত শিক্ষানীতি। অতীতে প্রতিটি সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়ের জন্যে একটি কমিটি করেছে এবং যথারীতি ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে এর ফল প্রকাশ করেছে, কিন্তু বর্তমান সরকার এমনটি করেনি। শিক্ষা কমিশন করেছে, তাদের নীতি প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা পদক্ষেপও নিয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় দেশে শুরু হয়েছিল জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) নামক পরীক্ষা।

করা হয়েছিল সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি। এক যুগের কম সময়ে এসব বাতিল হয়ে এখন নতুন ধারার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিক্ষার মূল ভিত্তি। একটি উর্বর মাঠ হলো প্রাথমিক স্তর, এখানে যদি সঠিক বীজ বুনতে না পারি, তবে কোনো অবস্থাতেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষার মান আজ নিম্নে এই অবস্থা বোঝার জন্য অনেক দূর চিন্তার প্রয়োজন নেই। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জিপিএ ৫ প্রাপ্তির এই মহোৎসবের মধ্যেও অধিকাংশ জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে উঠতে পারছে না। কেন?

শিক্ষার মূল স্থানটি হলো শ্রেণিকক্ষ অথচ শ্রেণিকক্ষের অবস্থা আজ তেমন ভালো নয়। মেধাবীরা সেখানে আজ আসছে না। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলাদেশে শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে, তবে তা টেকসই নয়। কারও সহায়তা বা সমর্থনের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের মেধা, সম্পদ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়নে চেষ্টা করতে হবে। এই কথাগুলো বলেছেন শিক্ষাবিষয়ক একটি সেমিনারে বক্তারা। বক্তারা আরও বলেন, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে সরকার, দাতা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে অন্যথায় শিক্ষার আজকের অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সক্ষমতাগুলো কোনো অজানা কারণে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ব্যয় এবং বিনিয়োগের তুলনায় আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রটা অনেক পিছিয়ে আছে একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হবে। কেন এই অবস্থা তাও নির্ণয় করা জরুরি। উর্বর মাঠে বীজ বুনতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পরিকল্পনা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা।

জিপিএ ৫ প্রাপ্তির যে হার, সেই হার অনুযায়ী গুণগত শিক্ষার প্রসার হয়নি। শিক্ষার মানের অবস্থা বোঝার জন্য এটি একটি দৃষ্টান্ত। শ্রেণি কক্ষগুলোকে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে এবং এই কাজটি খুব জরুরিও বটে। ভিড়ে ঠাসা শ্রেণিকক্ষগুলোতে আজ শিক্ষার সাধারণ পরিবেশও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শিক্ষার্থী সিলেবাস শেষ করল কি না সেটি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর কাছে প্রধান। কী শিখল আর কী পারল—তা বিবেচ্ছ নয়। এই অবস্থার কারণে আজ বর্ণমালা না শিখেও শ্রেণি টপকানোতে বেশি মনোযোগ সবার। এখন শুরু ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ আর বৃত্তের বছর।

ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ আর বৃত্তের এই সময়ে মানের যেই প্রশ্ন, তার উত্তর মিলবার আগেই মনে হয় শিক্ষার হাল ভিন্নদিকেই ফিরে যাবে। টিকে থাকবার কোনো পথ আমি দেখছি না। সামান্য শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা বলে আমরা পেছনে যাচ্ছি। অথচ জীবনের সব আয়োজন সামনে যাওয়ার। আমরাও সামনে যাই। আধুনিক পৃথিবীকে ছুঁয়ে দেখতে হলে সেই রকম অবস্থা শুধু বই আর পদ্ধতি পরিবর্তনে সম্ভব নয়। শিক্ষক, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, কাঠামো, মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনও ঘটাতে হবে। সেটি সম্ভব হয়েছে কী? উত্তর না। তাহলে। বড়ই হতাশার।

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার মানে যেই প্রশ্ন এসেছে, তা নিয়ে গভীরে যেতে হবে। ভাবতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে। কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষার আজকের যেই অবস্থা, তার জন্য শিক্ষার সার্বিক কাঠামো দায়ী। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে তৈরি করতে হবে এক সুসস্পর্ক। অন্যথায় মনে রাখবেন কোনোমতেই আধুনিক শিক্ষার যে চিন্তা, তা ফলপ্রসূ হতে পারে না। গুণগত শিক্ষার ধারে কাছেও আজ আমরা নেই। আমাদের সবার কাছে এখন প্রতিযোগিতা—কতভাগ পাস ও কতজন জিপিএ ৫। শিক্ষার মানের সঙ্গে ভৌগোলিক অঞ্চল, শিক্ষকের বয়স, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের দিকটি বিবেচনায় আনতে হবে। ধনী-গরিবের ব্যবধান কমিয়ে এনে শিক্ষার একটি সার্বিক অবস্থা তৈরি করা দরকার। জাতি হিসেবে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় স্থান করার জন্য শিক্ষার চিত্রের মানের পরিবর্তন সর্বাগ্রে, এই কথাটুকু সবাইকে মনে ধারণ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ-নজরুল গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে সংবাদকর্মীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের

সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বন্ধ হচ্ছে ইউরোপের দরজা

লঞ্চের ধাক্কায় নদীতে পড়ে নারী নিখোঁজ

বিএনপিতে যোগ দিলেন জাতীয় পার্টির ২ শতাধিক নেতাকর্মী

ঢাবিতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে জ্ঞান হারালেন ছাত্রী

মে’র তাপমাত্রা নিয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ

নির্বাহী কমিটির সভা ডেকেছে যুবদল

ধান কাটতে গিয়ে হিটস্ট্রোকে ব্যবসায়ীর মৃত্যু

আগামীকাল দেশের পথে রওনা হচ্ছে এমভি আবদুল্লাহ 

১০

সেই নাবিকদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাল ইরান

১১

কুবি কোষাধ্যক্ষের গাড়ি আটকে দিল শিক্ষক সমিতি

১২

অলৌকিক ‘জাদুর কলের’ দেখা মিলেছে

১৩

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজেও ক্লাস শুরু রোববার

১৪

অভিভাবক ঐক্য ফোরাম / দাবদাহে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হলে দায় সরকারের

১৫

ধান বাঁধছিল রেজাউল, হিটস্ট্রোকে মৃত্যু

১৬

‘১০০ সাংবাদিক হইয়া গেছে, নির্বাচনে আর সাংবাদিক লাগবে না’

১৭

শহীদ শেখ জামালের জন্মদিন রোববার

১৮

নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করায় অর্থদণ্ড

১৯

বর্ষায় দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ করবে ছাত্রদল

২০
*/ ?>
X