মোস্তফা কামাল
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩৭ এএম
আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারি-দরকারি ছক্কায় অক্কা

সরকারি-দরকারি ছক্কায় অক্কা

জাতীয় পার্টি আর জাতীয়তাবাদী দল—একটির ডাক নাম জাপা, আরেকটির বিএনপি। দুটিই বিরোধী দল। চিহ্ন দিতে গিয়ে জাপাকে বলা হয় সংসদের বিরোধী দল, বিএনপিকে রাজপথের বিরোধী দল। বিএনপি ইদানীং নিজেরা নিজেদের আরও আলাদা করতে ‘গণতান্ত্রিক বিরোধী দল’ নামে সম্বোধন করে। এসব বাহুল্য কাজে সরকারের বিরুদ্ধে ছক্কা পেটাতে গিয়ে দলটি রাজনীতির বাউন্ডারি আউট প্রায়। আর জাপা ছক্কা পেটাচ্ছে নিজের ঘরে, একেবারে ফ্যামিলিতে। দেবর-ভাবিতে। হয় দেবর জি এম কাদের, নইলে ভাবি রওশন এরশাদ। হয় সাদ এরশাদ, নয় এরিক এরশাদ। মাঝেমধ্যে কারও কারও অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে এরশাদের সাবেক পত্নী বিদিশায় দিশা মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা। দলের এবং পরিবারের বাদবাকিদেরও ঘুরতে হচ্ছে এ চক্রে। এর বাইরে যাওয়ার দৃশ্যত পথ নেই।

তুলনা না খাটলেও দুই বিরোধী দলের রাজনীতির মাঠ ছোট হতে হতে নিজের ঘরে চলে এসেছে। দুই বিরোধী দলের দুটিকে নিয়েই সরকার নির্ভার। একটিকে নিয়েও সরকারের ভাবতে হচ্ছে না। বিএনপিতে টিম লিডার মা নইলে ছেলে। মাঝেমধ্যে পুত্রবধূ জোবায়দা-শর্মিলীর নাম সামনে এলেও টেকে না। টেকসই চিন্তায় মাঝেমধ্যে টেনে আনা হয় খালেদা জিয়ার নাতনি তারেককন্যা জাইমার নাম। তাও মিলিয়ে যায় দিন কয়েকে। সরকারবিরোধী ভূমিকা দলটির জন্য খুব দরকারি। আন্দোলনে ইস্তফা বা ব্যর্থতার ঘোষণা দেওয়ার অবস্থা নেই। তারা টানা আন্দোলনে আছে প্রায় ১৭-১৮ বছর। সময় বিচারে এটি বিশাল বিষয়। বিএনপির মতো একটি দল যে টিকে আছে, বড় কোনো ভাঙন হয়নি, হেভিওয়েট কোনো নেতা ডিগবাজি দেননি তা রাজনৈতিক মহলের জন্য ভাবনার উপাদান। এমন টানা ২১ বছর ভোগান্তি সওয়ার ইতিহাস ছিল শুধু আওয়ামী লীগেরই। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির পর মালেক, মিজান, রাজ্জাকসহ আওয়ামী লীগ ভেঙে হয়েছিল তিন-চার টুকরা। একাশিতে দেশে ফিরে ধাপে ধাপে এ ভাগগুলোকে একত্রিত করা শেখ হাসিনার ক্যারিশমেটিক রাজনীতির একটি।

রাজনীতিতে ভাঙা-গড়ার ইতিহাসে আন-প্যারালাল অবস্থা জাতীয় পার্টির। এরশাদের জীবদ্দশা থেকেই ভাঙন শুরু। ছয়-সাত দফায় ভেঙেছে। জাপা, জেপি, বিজেপি মিলিয়ে হালে মাঠে আছে অন্তত পাঁচটি। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি (জাফর) বাদে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিসহ চারটি দল জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। এরশাদের মৃত্যুর পর বিভেদ নতুন মাত্রা পেয়েছে, তবে ভাঙেনি। এবার দেবর-ভাবিতে ভাঙনের আরেকটি অভিযাত্রায় দলটি। রওশন এরশাদ তার সম্মেলন সেরেছেন। জি এম কাদেরও করবেন কয়েক মাস পর। নিজে কিছু বলেন না। মহাসচিব মুজিবুর রহমান চুন্নুসহ অন্যদের দিয়ে বলান। তারা রওশন এরশাদকে ‘বয়সের ভারে বেসামাল’, ‘পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়’—ধরনের মন্তব্য করেন। পরক্ষণেই বলেন, তিনি তাদের মায়ের মতো। এমন সার্কাস আবার জাপায় নতুন নয়। নেতাকর্মীরাও এতে অভ্যস্ত। তাদের ভাঙনগুলো এভাবেই হয়, হয়ে আসছে। ভাঙতে ভাঙতে তাদের মচকানোর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। হয়ে যাওয়া সম্মেলনের আগ থেকে রওশন এরশাদ দলের সাবেক, নিষ্ক্রিয় এবং বাদ পড়া নেতাদের সংগঠিত করছেন। অন্যদিকে জি এম কাদের দলে নিজের অবস্থান আরও সংহত করতে কাউকে পদোন্নতি, আবার অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের কাউকে কাউকে স্বপদে ফিরিয়ে আনছেন। বয়সে কমবেশি, পরিবর্তিত নতুন সময়ের মধ্যেও তারা কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে থাকেন না। বিনোদন জোগান দেন সবাই। ভাইরাল হন। তাদের আনলিমিটেড সার্কাস রাজনীতির মাঠকেও বিনোদন দেয়। আবার এরশাদ পতনের পর থেকে দলটি টিকে আছে এভাবেই। ভাইরাল তরিকাতেই। দলে এ গ্রুপ-সে গ্রুপ, বাইরে এ দল-ও দল, এ দেশ-ও দেশ করাই জাপার বৈশিষ্ট্য।

শুধু দলের নেতাকর্মী, অন্য দল বা দেশের মানুষ নয়, বিদেশি শক্তিগুলোও জাপাকে এভাবেই চেনে, জানে। নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্যেও জি এম কাদের ভারত ঘুরে এসেছেন। আবার বলেছেন, ভারত তাকে কী বলেছে তা বলতে তারা মানা করে দিয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর দরবারেও ঘুরেছেন। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না, আরও স্যাংশন আসবে—এমন মন্তব্য করেও ভাইরাল হয়েছেন নির্বাচনের আগে। পরে আরেক ভোল, সরকারের আস্থাভাজন বিরোধী দল হওয়ার লবিং। এত সফল হওয়ার পর বলছেন, গৃহপালিত বিরোধী দল হয়ে জাপার সর্বনাশ হয়ে গেছে। মাঠে মুখ দেখাতে পারছেন না। বাস্তবে পরিপাটি হয়ে মুখ দেখাচ্ছেন প্রতিদিনই। এ অবস্থার মধ্যে তিনি টানা এক ঘণ্টা মুখ দেখিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে। বুধবার বিকেলে তিনি মার্কিন দূতাবাসে হাসের দাওয়াতে গেছেন, না দাওয়াত বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে গেছেন—এ নিয়ে দুই ধরনের কথাই আছে। দল থেকে জানানো হয়েছে, সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে জি এম কাদের কতটা ভূমিকা রাখতে পারছেন, তা পিটার হাস জানতে চেয়েছেন। জবাবে জি এম কাদের বলেছেন, তারা বিরোধী দলের ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের পর এই প্রথম জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করলেন পিটার হাস। হাস-কাদেরের বৈঠক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও দলে বেশ ভ্যালু তৈরি হয়েছে। এ বৈঠকের আগের দিন দলে কয়েকজন অব্যাহতি ও কয়েকজনকে পদোন্নতি দিয়েছেন জি এম কাদের। বৈঠকের দিন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে জাপার চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যিনি একসময় ছিলেন রওশনের খাসলোক। জি এম কাদেরের কট্টর সমালোচক। নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের টাকা মেরে দেওয়ার তুমুল সমালোচক। মূলত নিজেদের স্বার্থেই দলের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে এই বিভক্তি। তারা একবার রওশনের দিকে যান তো কদিন পর জি এম কাদের পক্ষে। নির্বাচনের পর দুজন কো-চেয়ারম্যানসহ নয়জন প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদের পক্ষ নেন। নির্বাচনে সমঝোতার মনোনয়ন না পাওয়া এবং আর্থিক অসহযোগিতার অভিযোগে শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধ প্রকাশ পাওয়ার পর ৩০ জনের মতো নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা রয়েছেন। এ নেতারাসহ দলের কেন্দ্রীয় থেকে জেলা পর্যায়ের অনেক পুরোনো, নিষ্ক্রিয় এবং বিভিন্ন সময়ে বাদ পড়া নেতাদের সংগঠিত করে এগোচ্ছেন রওশনপন্থিরা। ভাগে না মিললে বা কম পড়লে তাদের কাদেরপন্থি হয়ে যেতে সময় লাগবে না। আবার সরকারি বা অসরকারি প্রণোদনায় পরিস্থিতি বদলে গেলে রওশনকে মা ডেকে হালের কাদেরপন্থিদের রওশনের কেবলায় চলে যাওয়াও সময়ের ব্যাপার। এই চাতুরীতে পারঙ্গম জাপার টপ টু বটম। এরশাদ পরিবারের সদস্যরাও। তার দুই পুত্র সাদ-এরিক থেকে স্ত্রী রওশন থেকে ভাই কাদের পর্যন্ত। এমন ঢোলে বাড়ির মধ্যে নাচুনি বুড়ির মতো খবরের জোগান দিলেন এরিক। এরশাদ ট্রাস্টের সম্পত্তির খোঁজখবর নিতে রংপুরে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এরিক এরশাদ ও তার মা বিদিশা এরশাদ।

রংপুর নগরের দর্শনা এলাকায় পল্লীনিবাস বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন এরিক এরশাদ। এ সময় পাশে ছিলেন বিদিশা এরশাদ। এরিক বলেন, ‘আমার ভরণপোষণের জন্য বাবা এরশাদ ট্রাস্ট গঠন করলেও আমি আমার প্রাপ্য অর্থ পাচ্ছি না। আমার কোল্ডস্টোরেজ আবদুল বারী ও মুকুলের ছেলেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের বোঝা উচিত, আমি এতিম, আমার বাবা নেই। এরপরও তারা আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করছেন। পরে বিদিশা বলেন, এরশাদ ট্রাস্টের যে কমিটি তা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলেও এরিকের সম্পত্তি হস্তান্তর করা হচ্ছে না। তার বাবা বেঁচে থাকাকালে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছে। বর্তমানে ট্রাস্টের সম্পত্তির টাকা না পাওয়ায় আর্থিক সংকট যাচ্ছে। হিমাগারের ৩০ শতাংশ শেয়ার এরিকের চাচা সামছুজ্জামানের নামে। তিনি এরিকের কোনো খোঁজ রাখেন না। এসব সার্কাসে এতে দলগত কু-দশা হলেও ব্যক্তিগতভাবে জাপার শীর্ষ যার জায়গায় নেতারা কামিয়াবি। দেবর-ভাবিসহ জনাকয়েকের আম-ছালা সবই থাকছে।

মা-ছেলের দ্বন্দ্বসহ বিষয়াদি নিয়ে বিএনপির দশা মোটেই জাতীয় পার্টির পর্যায়ে যায়নি। তবে বৃত্তবন্দিত্ব চলছে। বিরোধী দল নামের দুটি দল জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির এমন অভ্যন্তরীণ দশা স্বাভাবিকভাবেই সরকারের জন্য স্বস্তির। নির্ভার থাকার দাওয়াই। কিন্তু রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দলের অপরিহার্যতা এখানে প্রশ্নের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এর পরিণাম কী হতে পারে, মোটাদাগে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশ্বের কয়েকটি বিরোধী দলের এমন অক্কা দশার জের চোখের সামনেই ঘুরছে। সরকারগুলোর জন্য তা স্বস্তি-আনন্দ নির্ভারের হলেও আখের শুভ হওয়ার রেকর্ড কম।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ, যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

স্বামীর মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু

তবুও প্রার্থী হলেন সেই নাছিমা মুকাই 

গাজীপুরে কারখানার ১০ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নারী শ্রমিকের মৃত্যু

রাজশাহীতে আগুনে পুড়ে ছাই ১০ বিঘার পানের বরজ

বিয়েবাড়ি থেকে কনের পিতাকে তুলে নিয়ে টাকা দাবি

ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর , এলাকায় উত্তেজনা

ঈশ্বরদীতে ফেনসিডিলসহ রেল নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহি আটক

এমপি আনোয়ার খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ

১০

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১১৬ কোটিপতি প্রার্থী : টিআইবি

১১

রাইসির জন্য দোয়ার আহ্বান

১২

‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুদৃঢ় হয়েছে’ 

১৩

প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা সিটির কাছেই থাকল

১৪

বাংলাদেশকে লক্কড়ঝক্কড় দেশে পরিণত করেছে আ.লীগ : প্রিন্স

১৫

২০৩০ সালে সাড়ে ৫২ লাখ যাত্রী বহন করবে মেট্রোরেল  

১৬

পেনিনসুলা স্টিলের এমডিসহ চারজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

১৭

ইরানের প্রেসিডেন্টের সন্ধানে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, সাহায্য করতে চায় ইরাক

১৮

সাঈদ খোকনের বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলবেন না মেয়র তাপস

১৯

কিরগিজে সহিংসতার ঘটনায় ঢাকার উদ্বেগ

২০
X