কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২৮ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সিডনি শ্যানবার্গের প্রতিবেদনে প্রবাসী সরকার

জাকির হোসেন
সিডনি শ্যানবার্গের প্রতিবেদনে প্রবাসী সরকার

আজ ১৭ এপ্রিল। একাত্তরের এই দিনে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর অব্যাহত গণহত্যার মধ্যে মুজিবনগর সরকার গঠন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর মধ্য এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের যাত্রা বিশ্ববাসীকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। বিশ্বখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ মুজিবনগর সরকার নিয়ে প্রতিবেদন করেছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসে।

এই সিডনি শ্যানবার্গই সবার আগে বাংলাদেশে গণহত্যার খবর বিশ্ববাসীকে জানান। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে একাত্তরের ২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশ হয় তার দুটি প্রতিবেদন। এ দুটি প্রতিবেদনের একটির শিরোনাম ছিল—‘ইন ঢাকা, ট্রুপস ইউজ আর্টিলারি টু হল্ট রিভোল্ট, সিভিলিয়ানস ফায়ার্ড সেকশন অব ঢাকা আর সেট অ্যা ব্লেজ’। অর্থাৎ ‘পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান, জোর লড়াইয়ের খবর, সৈন্যরা কামান দাগিয়েছে, নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ, বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগ করেছে’। অন্যটির শিরোনাম ছিল—‘স্লিকস অ্যান্ড স্পেয়ার্স অ্যাগেইনস্ট ট্যাঙ্কস ইন ইস্ট পাকিস্তান’। অর্থাৎ ‘পূর্ব পাকিস্তানে ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে লাঠি ও বল্লম’।

সিডনি শ্যানবার্গের এ দুটি রিপোর্ট প্রকাশের দুদিন পর ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশ হয় ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের ‘ট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’। ওইদিন (৩০ মার্চ) প্রভাবশালী সাময়িকী টাইমে প্রকাশ হয় এপির সাংবাদিক মিশেল লরেন্টের প্রতিবেদন—‘অ্যাট ঢাকা ইউনিভার্সিটি বার্নিং বোডিস অব স্টুডেন্ট স্টিল লে ইন দেয়ার বেডস, অ্যা ম্যাসগ্রেব হ্যাড বিন হেইস্টিলি কাভার্ড’। অর্থাৎ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিছানায় তাদের দগ্ধ মৃতদেহ পড়ে আছে, একটি বিশাল হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে...’। এ দুটি প্রতিবেদন বিশ্বকে আরও বিশদভাবে জানিয়ে দেয়, পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী কি পৈশাচিক নির্যাতন ও নিপীড়ন করছে।

সত্তরের দশকে সিডনি শ্যানবার্গ ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের দিল্লি সংবাদদাতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশ হয়েছে সিডনি শ্যানবার্গের প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিবেদন। কোনো বিদেশি সাংবাদিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এতসংখ্যক রিপোর্ট করেছেন বলে জানা নেই। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যে কজন বিদেশি সাংবাদিক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেন, শ্যানবার্গ ছিলেন তার অন্যতম। ২৭ মার্চ সকালে যে ৩৫ জন সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহককে বলপূর্বক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে উঠিয়ে তাদের দেহ ও লাগেজ তল্লাশি করে ফিল্ম ও নোটবই ছিনিয়ে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বের করে দেওয়া হয়, সিডনি শ্যানবার্গ তাদের একজন। ২৭ মার্চের পর ঢাকা ত্যাগে বাধ্য হলেও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম তিনি অনুসরণ করেছেন, পাকিস্তান জেলে বঙ্গবন্ধুর অন্তরীণাবস্থাও ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এ সময় তার অধিকাংশ প্রতিবেদনই দিল্লি থেকে পাঠানো।

এপ্রিল মাসে শ্যানবার্গ ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বেশ অভ্যন্তরে চার দিনের সফর করেন। সফর শেষে ১৩ এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশ হয় তার ‘অব্যাহত হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বাঙালিদের মন্ত্রিসভা গঠন’ শীর্ষক প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনে বলা হয়—‘যদিও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বের বড় অংশ নিহত হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ এবং পাইকারি গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে, তা সত্ত্বেও আন্দোলনের হাইকমান্ডের কতক সদস্য বেঁচে আছেন এবং তারা একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ মুজিবের প্রধান সহকারী তাজউদ্দীন আহমদ, যার দল আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা-অভিমুখী পদক্ষেপ পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক অভিযান বয়ে এনেছে। বর্তমান সংবাদদাতা কর্তৃক ঘুরে আসা পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এক এলাকায় অন্তত ছয়জন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা একত্র হয়ে তাদের অভিহিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে মনোনীত করেছেন। তারা শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। তবে অপ্রকাশ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা স্বীকার করেন যে, তিনি বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে রয়েছেন। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্যাধীন কেন্দ্রীয় সরকার বলে চলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে; অন্যদিকে বাস্তব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি ফুটে উঠছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিদিনই যুদ্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পাকিস্তানিরা দলে দলে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সেনাবাহিনীর আশ্রয় পেতে কিংবা তাতে যোগ দিতে। হাজার হাজার উদ্বাস্তু তাদের যৎসামান্য জিনিসপত্র বস্তায় অথবা পিচবোর্ডের সুটকেসে ঠেসে ভারতে চলে আসছে সাময়িক আশ্রয়ের সন্ধানে। বর্তমান সংবাদদাতা দেখেছেন, প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় কিংবা লুকোবার জায়গা থেকে বঞ্চিত করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কুমিল্লার বহিসীমায় বাঁশ ও ছনের দগ্ধ ঘর থেকে যখন ধোঁয়া উঠছিল আকাশে, আক্রমণরত শকুনরা নেমে আসছিল মাটিতে, নিহত কৃষকের লাশের ওপর, যে লাশ নিয়ে ইতিমধ্যে কুকুর ও কাকের মধ্যে টানাটানি চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির কতজনকে পাকিস্তানি আর্মি হত্যা করেছে নিশ্চিতভাবে তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রের নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট অনুযায়ী, তা অন্তত হাজার হাজার তো বটেই, কেউ কেউ আরও বেশিও বলে থাকেন। কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ জারি করে, পূর্ব পাকিস্তানে সব বিদেশি সাংবাদিকের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অধিকৃত গ্রাম এলাকা থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে জানা যায়, যার অনেক কিছুরই পাকিস্তানি আর্মি বিরোধিতা করে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী স্বাধীনতা আন্দোলন দমনকল্পে পূর্ব পাকিস্তানের সব নেতা ও সম্ভাব্য নেতাদের হত্যা করেছে, গোটা অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছারখার করে দিয়েছে। আদেশপ্রাপ্ত হয়ে আর্মি, এখন যা সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা গঠিত, হত্যা করেছে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও নেতৃত্বের গুণসম্পন্ন অন্যদের, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগ থাকুক কিংবা না-ই থাকুক। ২৫ মার্চ সেনা অভিযান শুরুর পর যেসব বাঙালি অফিসার ও সৈন্য ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে গেরিলা দলে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী তাদের হত্যা করেছে। বেশিরভাগ অফিসারের পরিবারের লোকজনকে হত্যা করা হয়েছে, পালাতে পেরেছেন মাত্র অল্প কয়েকজন। নৌযান ও বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে আর্মি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তি—খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, পাটকল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কূপ ধ্বংস করেছে। ফলে দেশটি ২৫ বছর পিছিয়ে গেল, বলেছেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাগিচা থেকে ভারতে পালিয়ে আসা একজন স্কটিশ চা বাগান ম্যানেজার। পাকিস্তানি আর্মিকে ঠেকাতে মুক্তিবাহিনী রেললাইন ও সড়ক উড়িয়ে দিচ্ছে।

শ্যানবার্গ একাত্তরের জুন-জুলাই মাসে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের তত্ত্বাবধানে একদল বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে ঢাকা ও ফরিদপুর সফরের সুযোগ পান, যা তাদের দেখানো হলো সবই সাজানো, সেনা কমান্ডের ‘গাইডেড ট্যুর’ ভিন্ন অন্য কিছু নয়, অভিজ্ঞ সাংবাদিক শ্যানবার্গের তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। অক্টোবর মাসে, যখন মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে হটতে শুরু করেছে, সে সময় শ্যানবার্গ একাধিক মুক্তাঞ্চল সফর করেন। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানালে যে দীর্ঘ প্রতিবেদনটি তিনি প্রেরণ করেন, তাতে বাঙালিদের উল্লাসের খবর থাকলেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে, সে কথাই বড় করে জানান। ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত সে প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘বাঙালিরা আনন্দিত, কিন্তু তাদের নেতা এখনো অনুপস্থিত।’ শ্যানবার্গ ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মুক্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, সে সময় খুলনাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন শহর ও গ্রাম ঘুরে দেখার সুযোগ তার হয়। তিনিই প্রথম বিদেশি সাংবাদিক যিনি ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর সম্মুখ সমর প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। পাকিস্তান বাহিনীর হত্যাযজ্ঞও সরেজমিনে দেখে তার প্রামাণিক প্রতিবেদন পাঠকদের জন্য নিয়মিত পাঠিয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের ঘটনাও তিনি সম্মুখসারিতে বসে দেখার সুযোগ পান।

লেখক: সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডেলিভারি ম্যান নিয়োগ দেবে দারাজ, পদসংখ্যা ২০০

লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন

২৫ বছরের ইতিহাসে খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড

টানা বৃষ্টির সুখবর দিল আবহাওয়া অফিস

সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে বাবাকে পিটিয়ে মারল ছেলে

সাবেক দলের বিপক্ষে কেন উইকেট কম মোস্তাফিজের?

ট্রাক-পিকআপের সংঘর্ষে নিহত ২

হজ ভিসা আবেদনের সময় বাড়ল

প্রথম ম্যাচের ভুল শোধরাতে মাঠে নামছে জ্যোতিরা

চাঁদা না দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাকে বেধড়ক পেটালেন আ.লীগ নেতার ভাগনে

১০

জেনারেটর চলে না ডিমলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, রোগীদের ভোগান্তি বেড়েছে

১১

শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে বিএনপি সংকল্পবদ্ধ : মির্জা ফখরুল

১২

সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ হচ্ছে!

১৩

৭০ বছরেও প্রেমিকা খুঁজতে বিজ্ঞাপন, সপ্তাহে খরচ ৪৩ হাজার টাকা

১৪

সৌদি আরবে গৃহকর্মীর বাঁচার আকুতি

১৫

রেলের ভাড়া বৃদ্ধি সম্পূর্ণ জনস্বার্থবিরোধী : জাতীয় কমিটি

১৬

বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে কন্যাসহ গৃহবধূর অনশন

১৭

নারী উদ্যোক্তার বেডরুমে উড়ন্ত সাপ, অতঃপর...

১৮

ভুট্টা গাছ টানতেই বেরিয়ে এলো ৪৫ গোখরা সাপ

১৯

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

২০
*/ ?>
X