সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যুর মিছিলের সর্বশেষ নাম মাহিন। এ দুর্ঘটনার জন্য যে প্রধানত দায়ী সিটি করপোরেশনের অবহেলা ও উদাসীনতা, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। কেননা অতীতে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মারা যাওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রের মতো এ ঘটনায় দেখা গেছে একই রকমের অনিয়ম। এ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও গাড়িটির যিনি চালক ছিলেন তিনি প্রকৃত চালক নন। রুবেল নামের সেই চালক ময়লার গাড়ির একজন হেলপার। এসব অনিয়ম দেখার দায়িত্ব আসলে কাদের?
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মুগদার মদিনাবাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিভে গেছে ১৩ বছর বয়সী ছোট্ট মাহিন আহমেদের জীবনপ্রদীপ। সে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে হেঁটে চাচার বাসায় যাচ্ছিল মাহিন। মদিনাবাগে বেপরোয়া ময়লার গাড়িটি তাকে চাপা দেয়। দুর্ঘটনার পর মাহিনকে প্রথমে মুগদা হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে রাত ১টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আদরের সন্তানকে হারিয়ে বাবা-মা বাকরুদ্ধ। ছোট বোন আট বছর বয়সী ফাতেমা আফরিনের জিজ্ঞাসা, মাহিন ভাইয়া কি আর আসবে না? তার এ প্রশ্নের উত্তর এখন কে দেবেন? তবে মুগদা হাসপাতালে মাহিনকে প্রায় ৪০ মিনিট রক্তাক্ত অবস্থায় কোনোরকমের প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া ফেলে রাখা হয়েছিল, অর্থাৎ চিকিৎসায় অবহেলার যে অভিযোগ স্বজন ও স্থানীয়রা তুলেছেন, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। তথ্য বলছে, রাজধানীতে গত তিন বছরে ১৩ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সিটি করপোরেশনের বেপরোয়া ময়লার গাড়ি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব চালকের অনেকেরই নেই ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স। অভিযোগ রয়েছে, সিটি করপোরেশনের গাড়িচালকদের নিজেদের অনুকূলে বরাদ্দ থাকা গাড়ি বহিরাগত লোকদের দিয়ে চালানো হয়। এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস সহায়ক, মশককর্মীকে দিয়েও গাড়ি চালানোর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হত্যাকাণ্ড অবহেলাজনিত। ময়লার গাড়িগুলোতে সব ধরনের অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। ভারী যানবাহনগুলোর ফিটনেস সনদ নেই, দক্ষ চালক নেই। সিটি করপোরেশনের জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বাড়বে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথে অভূতপূর্ব আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। সে সময় শিক্ষার্থীরা সড়কের অনিয়মগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সড়ক, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এবং নানা মহলের মানুষ স্বীকার করে, শিক্ষার্থীরা তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাফিকব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত সব সংস্থার আওতাধীন যানবাহন এবং কর্মচারীরা যেন ট্রাফিক আইন মেনে চলে সেটি নিশ্চিত করাসহ সংস্থার প্রধানদের বিষয়টি নজরদারির নির্দেশ দেয় ওই কমিটি। সেসব নির্দেশনা কি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে? ডিএসসিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে সব এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহের সার্বিক কাজ শেষ করার কথা। তা কি সর্বত্র মানা হচ্ছে? ‘আমি বুঝতে পারতেছি, আমি আর বাঁচব না ভাইয়া। তুমি বাবা-মাকে দেইখো। বোনের খেয়াল রাইখো।’— চিরবিদায়ের আগে হাসপাতালে রক্তাক্ত অবস্থায়ও বড়ভাই মাহফুজকে পরিবারের প্রতি দায়িত্বের নিদর্শনস্বরূপ এসব বলে গেছে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিন। আর আমরা যারা দেশের আরও বড় দায়িত্ব নিয়েছি, তারা কি ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করছি?