বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ঘটনাবহুল, টালমাটাল। মাঠে, মাঠে বাইরে, পর্দার সামনে এবং সম্ভবত পর্দার আড়ালেও চলছে নানান তৎপরতা। আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই চলছে দেশি-বিদেশি সব তৎপরতা। একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রবল চাপ তৈরি হচ্ছে। এ চাপটা আসার কথা বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, চাপটা আসছে বিদেশিদের কাছ থেকে। জনগণ এখানে দাবার ঘুঁটি মাত্র। বিদেশিদের দেখানোর জন্য জনগণকে ডেকে এনে দুই দলই ঢাকায় সমাবেশ করেছে, সমাবেশ থেকে একদফা ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাতে জনগণের ভোগান্তিই হয়েছে শুধু। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই সরকারবিরোধী আন্দোলন করে আসছে। গত ১২ জুলাই তারা সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করেছে। কিন্তু কোনো আন্দোলনেই তারা তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ২০১৩-১৪ সালে আন্দোলনের নামে সহিংসতা করে অনেক মানুষের প্রাণহানি আর বিপুল দুর্ভোগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারলেও দাবি আদায় করতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে, ২০১৮ সালে নামকাওয়াস্তে অংশ নিয়েও কোনো বদল ঘটাতে পারেনি বিএনপি। এখন বিএনপি বুঝে গেছে, আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর সক্ষমতা নেই তাদের। এটা বুঝে যাওয়ার পর বিএনপি নানাভাবে বিদেশি শক্তিগুলোর দ্বারস্থ হয়। ভাবটা এমন যে, বিদেশিরা এসে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। বিএনপির নানামুখী লবিংয়েই হোক বা নিজেদের গণতন্ত্রপ্রীতির কারণেই হোক; যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে অতি আগ্রহ দেখানো শুরু করে। বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের এই অতি আগ্রহ বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের নাক গলানো; আমাদের জন্য লজ্জার, গ্লানির। কিন্তু শেষ বিচারে তাদের তৎপরতা বাংলাদেশের জন্য খারাপ হয়নি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর বদলে যায় দৃশ্যপট। কার্যত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশে। এখন আর কোনো বাহিনী অস্ত্র উদ্ধারে বের হয় না। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির এ নাটকীয় উন্নতির কথা যুক্তরাষ্ট্রও স্বীকার করেছে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত মে মাসে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এ ভিসা নীতি সরকারি ও বিরোধী দল সবার জন্যই প্রযোজ্য। র্যাবের নিষেধাজ্ঞা যেমন মানবাধিকার পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি ঘটিয়েছিল, ভিসা নীতি তেমনি নির্বাচন প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে নাটকীয় উন্নতি আনে। ভিসা নীতি ঘোষণার পর অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশনসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই। বিএনপিসহ সব বিরোধী দল এখন নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পারছে। পুলিশের আচরণও বদলে গেছে। বিএনপিও আর মামলা-হামলার অভিযোগ করছে না। এমনকি জামায়াতে ইসলামীও ১০ বছর পর ঢাকায় কর্মসূচি পালনের সুযোগ পেয়েছে। ভিসা নীতি ঘোষণার পর মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া ঢাকা এসে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে সরকারের অঙ্গীকারে তারা আশ্বস্ত হয়েছেন।
এটা মানতেই হবে, যুক্তরাষ্ট্রের নানা তৎপরতায় সরকার এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রবল চাপে পড়েছে। ১৪ বছরের দেশ চালানোর স্টাইল বদলে গেছে দুই বছরেই। ডালভাতে পরিণত হওয়া ক্রসফায়ার আর গুম ছাড়াই দেশ চালাতে পারছে তারা এখন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশও সংকুচিত ছিল। মামলা-হামলায় পর্যুদস্ত ছিল বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী শক্তিগুলো। বিরোধী দল মাঠে কোনো কর্মসূচি দিলেই সরকারি দল নানা কৌশলে তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করত। কিন্তু হঠাৎই বদলে গেছে পরিস্থিতি। গত ১২ জুলাই মাত্র দেড় কিলোমিটারের মধ্যে সমাবেশ করেছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। দুই দল মাঠে ছিল, পাশাপাশি মিছিলও হয়েছে। কিন্তু কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। কত বছর পর বিএনপি ঢাকায় সমাবেশের মাইকিং করতে পেরেছে, তা বোধহয় তারাও জানে না। এ শান্তিপূর্ণ সমাবেশও আজরা জেয়াকে আশ্বস্ত করেছে। আগামী সেপ্টেম্বরে সংশোধন করা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে, আশা করা যায় সামনে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমাদের চাপ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর বিকল্প নেই সরকারের সামনে। না হলে চাপ আরও বাড়তে পারে। এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চাপে আছে। বাড়তি কোনো চাপ নেওয়ার সক্ষমতা এখন বাংলাদেশ সরকারের নেই।
সরকারি দল প্রবল চাপে থাকলেও স্বস্তিতে নেই বিএনপি। সরকারের নানা ছাড়ে আপাতত কিছুটা স্বস্তি পেলেও নিজেদের মূল দাবির ব্যাপারে কোনো আশ্বাস পায়নি বিএনপি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু কেউ একবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেনি। তাদের সব তৎপরতা বিদ্যমান ব্যবস্থায় কীভাবে একটি ভালো নির্বাচন করা যায়; তাতেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। আর যেহেতু পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা নেই, তাই এটা নিয়ে বাইরের কারও ওকালতি করার নৈতিক ভিত্তি নেই। এখন যেভাবে সবকিছু এগোচ্ছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমাদের কথা মানলে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে বিএনপিকে। তাতে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি থেকে পিছিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনের আগেই তাদের রাজনৈতিক পরাজয় ঘটবে। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শ সত্ত্বেও বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে সেই বন্ধুদের সহানুভূতি হারাবে তারা। তার চেয়ে বড় কথা, ২০১৪ সালের মতো এবার নির্বাচন প্রতিহত করার নামে সন্ত্রাস করার সুযোগ নেই। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রযোজ্য হবে তাদের ওপরই। একই যুক্তিতে সহিংস আন্দোলনেরও সুযোগ নেই। পশ্চিমারা অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন যেমন চায়; শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিও চায়। বিএনপির এখন খাল কেটে কুমির আনার দশা। সবকিছু নিয়েই কথা হচ্ছে। কিন্তু কারও মুখেই বিএনপির মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি বাংলাদেশ সফর করে গেলেও বিএনপি তার টিকির নাগালও পায়নি। শুধু এবার নয়, এর আগের দুই মার্কিন কর্তার সফরেও বিএনপির সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।
বর্তমান ব্যবস্থাতেই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বাত্মক সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে, মনিটর করবে, প্রয়োজনে চাপ দেবে। আগের মতো খারাপ নির্বাচন করে এবার পার পাওয়ার সুযোগ নেই আওয়ামী লীগের। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ভিসা নীতি তো আছেই, প্রয়োজনেই নতুন নতুন চাপ আসতে পারে। নির্বাচনের পর প্রয়োজনে সে চাপ আরও প্রবল হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি আরও একটি নির্বাচনে বাইরে থাকবে, নাকি বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদের। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী, ক্ষমতামুখী দল। আরও একটি নির্বাচন বর্জন করার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা বিএনপির আছে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। আবার প্রবল আন্দোলন করে দাবি আদায় বা নির্বাচন প্রতিহত করারও কোনো সুযোগ নেই। তাতে উল্টো নিজেরাই চাপে পড়বে। সরকারি দল যে প্রবল চাপে পড়েছে, তা কাজে লাগাতে হলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিএনপিকে। একদফা আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে হবে। না হলে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও তারা প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাবে না। ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন যেমন আওয়ামী লীগের পক্ষে হজম করাও কঠিন, বিএনপির জন্যও কঠিন।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
মন্তব্য করুন