ড. শ্রী বীরেন শিকদার
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ০৯ মে ২০২৪, ০৭:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সিগারেটের ওপর কার্যকর করারোপ প্রয়োজন

সিগারেটের ওপর কার্যকর করারোপ প্রয়োজন

বিড়ি, সিগারেটসহ সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলা অনাবশ্যক। আমরা সবাই এখন কমবেশি জানি যে, তামাকজাত দ্রব্যের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক। তামাকের বিপুল ব্যবহারের কারণে তামাক ব্যবহারকারীরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি তারা মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেও পড়ছেন। তামাকের সহজলভ্যতার কারণে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর এ দেশে মৃত্যুর সংখ্যা কম নয়। চিকিৎসকরা বারবার এ বিষয়ে সতর্ক করছেন। গবেষকরাও গবেষণা করে হাতেনাতে দেখিয়ে দিচ্ছেন সিগারেটসহ তামাকের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাটা কেমন। তামাক ব্যবহারের কুফল হিসেবে পরোক্ষ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও এখন অনেক বেশি। উন্মুক্ত স্থানে সিগারেট, বিড়ি খাওয়ার কারণে পাশের ব্যক্তিটিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নীরবে-নিভৃতে।

আমরা দেখছি তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে নানান ধরনের সচেতনতা চলমান রয়েছে। সেই সচেতনতার ঢেউ শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে এ কথা সত্য, যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান সরকার তামাকের ব্যবহার বন্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং যা রাষ্ট্রের আইনকানুনের মধ্যেও আনা হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে বরাবরই ইতিবাচক দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছেন। সরকারের আইনপ্রণেতা এ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং অনেক আইনপ্রণেতা সিগারেটের বিপুল ব্যবহার বন্ধে শুধু সংসদ নয়, গ্রামগঞ্জে সর্বত্র সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। আমি নিজেও সর্বত্র তামাক ব্যবহার না করার জন্য সবাইকে উৎসাহী করি। নিজ নির্বাচনী এলাকায় যখন সর্বসাধারণের সঙ্গে কথা বলি তখনো আমি তামাক ব্যবহারের নেতিবাচক বার্তাগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরি। জাতীয় পর্যায়ের অনেক সভা-সেমিনারেও আমি এ বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেছি। প্রধানমন্ত্রীর দেশকে তামাকমুক্তকরণের যে ঘোষণা, যে প্রত্যয়—সে বিষয়েও সবাইকে জ্ঞাত করি।

তামাকের ব্যবহার তথা সিগারেটের বিপুল ব্যবহার বন্ধে বা কমিয়ে আনতে সিগারেটের দাম বাড়ানো একটি কার্যকর কৌশল। তামাকের ওপর কার্যকর করারোপের বিষয়টি আমরা দেখে আসছি। এ থেকে ইতিবাচক ফল যে আসেনি তা কিন্তু নয়, ভালো ফল এসেছে। আসলে যে কোনো পণ্যের দাম বাড়ালে তার চাহিদা কিছুটা হলেও কমে আসে। প্রতি অর্থবছরে আমাদের বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়ার খবর পাওয়া যায়। খোলা চোখে এ দামবৃদ্ধি ইতিবাচক মনে হলেও মূল্যস্ফীতি এবং মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি বিবেচনায় নিলে বোঝা যায় এ দাম আসলে যথেষ্ট বাড়ানো হচ্ছে না। কার্যকরভাবে সিগারেটের দাম না বাড়ানোর কারণে তা সহজলভ্যই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী নাগরিকদের ১৫ শতাংশের বেশি সিগারেট ব্যবহার করছে। সে বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ সিগারেট ব্যবহারকারী দেশগুলোর একটি।

প্রতি বছর সিগারেটসহ অন্যান্য তামাকপণ্য ব্যবহারজনিত কারণে এ দেশে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এ ছাড়া তামাকপণ্য ব্যবহারজনিত কারণে হওয়া রোগব্যাধির চিকিৎসাবাবদেও বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সিগারেটের এ সহজলভ্যতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কম আয়শ্রেণির নাগরিকরা। কেননা আয় কম হওয়ার কারণে সিগারেট ব্যবহারজনিত রোগের ক্ষেত্রে তাদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপও বেশি পড়ে। এ ছাড়া কিশোর-তরুণদের সিগারেট ব্যবহারের প্রবণতাও বিশেষ দুর্ভাবনার বিষয়। কারণ আগামী প্রজন্মের এ নাগরিকদের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হলে তা পুরো জাতির ভবিষ্যতের জন্যই হুমকি হয়ে যায়। কম আয়শ্রেণির নাগরিক এবং কিশোর-তরুণরা স্বভাবতই বাজারের সবচেয়ে সস্তা সিগারেটগুলো ব্যবহার করে থাকে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বাজারে চার স্তরের সিগারেট পাওয়া যায়। তার মধ্যে সবচেয়ে সস্তাগুলো হলো ‘নিম্ন স্তর’-এর সিগারেট। এগুলোর দশ-শলাকার একেকটি প্যাকেটের খুচরামূল্য বর্তমানে ৪৫ টাকা।

বাজারে মোট যে সিগারেট বিক্রি হয় তার মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশিই নিম্ন স্তরের সিগারেট। এগুলোর প্রধান ক্রেতা নিম্ন আয়ের মানুষ এবং কিশোর-তরুণরা। তাদের কাছে সিগারেটের সহজলভ্যতা কমাতে তাই আসছে বছরের বাজেটে এ স্তরের সিগারেটের দশ-শলাকার এক প্যাকেটের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৬০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে দেশের তামাকবিরোধী নাগরিক সংগঠনগুলো। অন্য তিন স্তর, অর্থাৎ মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের দশ-শলাকার একেকটি প্যাকেটের দামও যথাক্রমে ১৯ শতাংশ, ১৫ শতাংশ এবং ১৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে মধ্যম স্তরের সিগারেটের দশ-শলাকার প্যাকেটের দাম ৬৭ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা, উচ্চস্তরের সিগারেটের দশ-শলাকার প্যাকেটের দাম ১১৩ থেকে বেড়ে ১৩০ এবং প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের দশ-শলাকার প্যাকেটের দাম ১৫০ থেকে বেড়ে ১৭০ টাকা হবে।

বর্তমানে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির কথা মাথায় রেখেই বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের দাম এভাবে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করেছে নাগরিক সংগঠনগুলো। এ ক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গবেষকরা। সিগারেটের দাম বৃদ্ধির এ প্রস্তাবনা এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে, যাতে করে সিগারেট বিক্রি থেকে আসা রাজস্বে কোনো আকস্মিক চাপ না পড়ে। যেমন—নিম্ন স্তরের সিগারেটের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি এগুলোর ওপর বর্তমানে যে ৫৮ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা আছে, তা বাড়িয়ে ৬৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি আগের মতো ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল থাকবে। ফলে প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে নিম্ন স্তরের সিগারেট বিক্রি কমলেও এখান থেকে আগের তুলনায় বেশি কর পাওয়া যাবে। মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের ওপর আগের মতোই ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল রাখা হয়েছে। তবে খুচরা মূল্য প্রস্তাবনা অনুসারে বাড়ালে একই করহার বহাল রাখার পরও এসব সিগারেট বিক্রি থেকে আসা কর বাড়বে।

ধারণা করা হচ্ছে, এ প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে আসন্ন অর্থবছরে সিগারেট বিক্রি থেকে চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে দেশে ধূমপানের হারও ১৫.১ শতাংশ থেকে কমে ১৩.৮০ শতাংশ হবে। অনেক কিশোর-তরুণ সিগারেট ব্যবহার শুরু করা থেকে বিরত থাকবে এবং সর্বোপরি ধূমপানজনিত কারণে অকালমৃত্যুও ঠেকানো যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটি বাস্তবায়নে আমাদের কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

এ কারণেই আসছে অর্থবছর থেকে সিগারেটে কার্যকর করারোপ করে পরবর্তী বছরগুলোতে এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। আর এ ধারাবাহিকতা রক্ষা হলে ধীরে ধীরে সিগারেটের ব্যবহার আরও কমে আসবে। সিগারেটের ব্যবহার যত কমে আসবে, ততই জনস্বাস্থ্য সুন্দর ও সুরক্ষিত হবে। একই সঙ্গে নিম্ন আয়ের মানুষ এ অযাচিত খরচের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে ইতিবাচক সব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে নিবেদিত হই।

লেখক: সংসদ সদস্য, মাগুরা-২

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হবিগঞ্জে ধান সংগ্রহের শুরুতেই হযবরল

আইপিএলে প্লে-অফে কে কার বিরুদ্ধে লড়বে?

তুর্কি ড্রোনে খোঁজ মিলল রাইসির হেলিকপ্টারের

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি বেঁচে আছেন? 

খোঁজ মিলল রাইসির হেলিকপ্টারের, দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২ কিমি দূরে উদ্ধারদল

পেকুয়া উপজেলা নির্বাচন / পড়ালেখায় এগিয়ে সজিব, অর্থসম্পদে আবুল কাসেম

রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি

‘রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের খোঁজ পাওয়া গেছে’

কোরবানির ঈদকে ঘিরে স্বপ্নপূরণের আশা খামারিদের

দুই বোনকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো ছাত্রলীগ নেতা পায়েল বহিষ্কার

১০

বন্ধুর বাড়ি থেকে যুবকের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার

১১

রাইসির ঘটনায় উচ্ছ্বসিত মার্কিন সিনেটর

১২

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৩

প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনিয়ে পালাচ্ছিলেন পুলিশ সদস্য

১৪

রাইসিকে উদ্ধারকাজে বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে রাশিয়া

১৫

রাইসিকে উদ্ধারের সর্বশেষ অবস্থা জানাল ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

১৬

সংস্কারের দুদিন পরই উঠে যাচ্ছে কোটি টাকার কার্পেটিং!

১৭

বজ্রপাতে কলেজছাত্রের মৃত্যু

১৮

ঘুষ নিয়ে এএসআইয়ের দর-কষাকষির অডিও ভাইরাল

১৯

রাইসির খোঁজে যে ঘোষণা দিল এরদোয়ান

২০
X