১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের সহিংসতা শুধু গণহত্যা বা জেনোসাইডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সে সময় প্রায় সাড়ে চার লাখ নারীকে শহর-বন্দর-গ্রামে ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মতো পাশবিক নির্যাতন করা হয়। ৭১-এ এরকম হাজার হাজার নির্যাতিতা চরম দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে। যারা এখনো বেঁচে আছেন, তাদের প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে দুঃসহ অপমান ও অত্যাচারের স্মৃতি। এসব ধর্ষিতার মধ্যে যারা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন, তাদের অনেককে ঢাকার কয়েকটি ক্লিনিকে এনে দেশি ও বিদেশি এনজিওর সহায়তায় গর্ভপাত ঘটানো হয়। যেসব যুদ্ধশিশুর জন্ম হয় তাদের প্রতিপালনের জন্য মাদার তেরেসা পরিচালিত শিশুভবন বা বেবিহোম নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া কেয়ার, কারিতাস, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্ক্যান্ডেভিয়ান দেশের সহায়তায় বেশ কিছু যুদ্ধশিশুকে দত্তক হিসেবে নিয়ে যায় সেসব দেশের বহু পরিবার।
দেশের অভ্যন্তরে যেসব যুদ্ধশিশু আমরা খুঁজে পাই তার মধ্যে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুনকে অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে যুদ্ধশিশু হিসেবে স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও মেরিনা খাতুনের এ স্বীকৃতিতে অনেক উচ্ছ্বসিত তার পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। তবে তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো মাসিক ভাতা দেওয়ার কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকায় খানিকটা হতাশও তারা।
কিন্তু এ সামগ্রিক চিত্রটা তুলে আনা এত সহজ ছিল না। এর পেছনে দীর্ঘ এক ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করেছেন ৭১ টিভির সিরাজগঞ্জের বার্তা প্রতিনিধি সাংবাদিক মাসুদ পারভেজ, যিনি দীর্ঘ এক জীবন ধরে সন্তানের মতো লালন করে চলেছেন সিরাজগঞ্জের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা মায়েদের।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের পাশবিক নির্যাতনে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা পচি বেগমের গর্ভে আসে মেরিনা খাতুন। লোকলজ্জার ভয়ে ভ্রূণেই মেরিনাকে শেষ করতে চাইলেও অন্য সন্তানদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত মেরিনার জন্ম দেন মা পচি বেগম। পচি বেগম রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০১৮ সালে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পান। ২০২২ সালে সাংবাদিক মাসুদ পারভেজ মেরিনা খাতুনকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে যুদ্ধশিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদনের সবরকম সাহায্য-সহযোগিতা করেন এবং মেরিনা খাতুন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদনপত্র প্রেরণ করেন।
জামুকার ৮২তম সভায় মেরিনাকে যুদ্ধশিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রিসভায় প্রস্তাবটি পাঠানো হয়। দীর্ঘ সময় পর মন্ত্রিসভা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে চিঠি দেয় জামুকাকে। তারই আলোকে জামুকার ৮৯তম সভায় মেরিনাকে যুদ্ধশিশু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার ঘোষণায় উচ্ছ্বসিত যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুনের পরিবার। এবার বাবার নাম অজ্ঞাত রেখেই রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন মেরিনা। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে ভাতা পাওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলেই জানা যায়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধশিশু হিসেবে মেরিনার এ স্বীকৃতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে মনে করেন।
যুদ্ধশিশুর স্বীকৃতি রাষ্ট্রে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা। তবে তাদের মাসিক ভাতা প্রদানের দাবি আমাদের আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখতে হবে বলে মনে হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের সন্ধানে তিনজন যুদ্ধশিশুর পরিচয় আছে। যুদ্ধশিশু মেরিনার স্বীকৃতির পর বাকি দুজনের স্বীকৃতিও খুব দ্রুত অর্জন হবে বলে আমরা আশা রাখছি।
লেখক: সমাজকর্মী