জওহরলাল নেহরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। এ ছাড়া ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতার ভূমিকাও পালন করেছেন নেহরু। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, আদর্শবাদী, পণ্ডিত এবং কূটনীতিবিদ নেহরু ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। লেখক হিসেবেও ছিলেন বিশিষ্ট। ইংরেজিতে লেখা তার তিনটি বিখ্যাত বই ‘একটি আত্মজীবনী’, ‘বিশ্ব ইতিহাসের কিছু চিত্র’ ও ‘ভারত আবিষ্কার’ চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। জওহরলাল নেহরুর জন্ম ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর, ব্রিটিশ ভারতের এলাহাবাদে এক কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ পরিবারে। কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার সংযোগের কারণে ‘পণ্ডিত নেহরু’ নামেও পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় শিশুরা তাকে চেনে ‘চাচা নেহরু’ হিসেবে। এ কারণে নেহরুর জন্মদিন ভারতে পালিত হয় শিশু দিবস হিসেবে। বাড়িতে পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠেন। ইংরেজির সঙ্গে হিন্দি ও সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হতো। তৎকালীন ভারতের সব থেকে আধুনিক স্কুলে পড়ার পর প্রায় ১৫ বছর বয়সে নেহরু ইংল্যান্ডের হ্যারোতে চলে যান। তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানের ওপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি কেমব্রিজেই ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন। জওহরলাল নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরু ১৯১৯ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জওহরলালের বড় বোন বিজয়লক্ষ্মী ছিলেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রথম নারী সভাপতি ও ছোট বোন কৃষ্ণা নাম করেছেন লেখক হিসেবে। কৃষ্ণা তার ভাইকে নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। ছোটবেলা থেকেই নেহরু বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মহাত্মা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে নেহরু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। পরবর্তীকালে তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও দৌহিত্র রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-২২ সাল) সময় নেহরু ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রথমবারের মতো কারারুদ্ধ হন। পরবর্তী আড়াই দশকে তাকে কারাগারে থাকতে হয় ৯ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার সময় ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয় ব্রিটেন। এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস সদস্যরা ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট ‘ভারত ছাড়’ প্রস্তাব পাস করেন এবং ব্রিটেনের কাছ থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দাবি করে ভারত। পরদিন ব্রিটিশ সরকার নেহরু, গান্ধীসহ কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার করে।
জওহরলাল নেহরু তার ১৭ বছরের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ছিলেন। ভারতের শিল্পায়নকে উৎসাহিত করেন তিনি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর দেন বিশেষ গুরুত্ব। উচ্চশিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখেন সুচিন্তিতভাবে। বিভিন্ন সামাজিক সংস্কার, যেমন—ভারতীয় শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা এবং খাবার, নারীর আইনি অধিকার ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার, স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতাসহ বিভিন্ন আইন তৈরি করেন। ১৯৬৪ সালের ২৭ মে মারা যান এ বিশিষ্ট ব্যক্তি।