ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা কতটা ভয়ানক হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে কম নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশেও বারবার মৃদু ও মাঝারিমাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানছে। এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কখনো দেশের সীমানার ভেতরে বা আশপাশে। ছোট ছোট এসব ভূমিকম্প যে ভবিষ্যতে বড় আকারে আঘাত হানতে পারে এবং সেই আঘাতে দেশ, বিশেষত ঢাকা শহরের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কী রূপ নিতে পারে—বিশেষজ্ঞরা বারবার এসব বিষয়ে সতর্কও করে করছেন বিভিন্ন সময়। সত্যিকারই যদি বড় রকমের কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানে, তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আসলে কতটা রয়েছে; যেহেতু ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা যায় না, তাহলে কতটা ক্ষতি কমানোর পূর্বপ্রস্তুতি এবং আঘাতের পর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় কতটা সক্ষম আমরা—এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যদিও এর উত্তর খুবই সহজ! এ সক্ষমতা যে খুবই নগণ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!
রোববার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট একটি মাত্রায় ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের কী পরিণতি হতে পারে, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যা সত্যিই ভয়ে শিউরে ওঠার মতো। প্রতিবেদন অনুসারে, টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরে একটি ফল্ট রয়েছে। সেখানে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ আর সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়বে। ঢাকায় কাঁচা-পাকা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ২১ লাখ ভবন আছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে উল্লিখিত মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। আর দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবে প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষ এবং আহত হবে সোয়া দুই লাখের বেশি। আঘাতের ফলে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে সিলেটের ডাউকি চ্যুতি রেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার শহরে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি চিত্র উঠে আসে গত শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আয়োজিত ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলাবিষয়ক এক সেমিনারের আলোচনায়। এ ছাড়া ঢাকায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ করা সম্ভব এবং কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে, যা অপসারণসহ ভূমিকম্প সহনশীল টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে পরিকল্পিতভাবে ভবন কোড মেনে উন্নয়ন, অবকাঠামোগত কাজে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সচেতনতা বৃদ্ধির মতো বিষয় আলোচিত হয়।
আমরা জানি, ভূমিকম্প এমন এক প্রাকৃতিক হুমকি, যার পূর্বাভাস সুনির্দিষ্টভাবে দেওয়া অসম্ভব। বিশেষজ্ঞরা ভূতাত্ত্বিক গঠন, অবস্থানসহ নানা বিষয় বিশ্লেষণ করে শুধু এর ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল সম্পর্কে জানাতে পারেন। ফলে ভূমিকম্প হলে যেন ক্ষতি কম হয় এবং হওয়ার পর যেন দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারি—এসব প্রস্তুতিই প্রধান।
আমরা মনে করি, বড় রকমের ভূমিকম্পের সম্ভাব্য বিপদ ও ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে হলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি এবং সমন্বিত উদ্যোগ-প্রস্তুতি নিয়ে এগোনোর কোনো বিকল্প নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সবার আগে ভেঙে ফেলতে হবে। স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে ভবন কোড অনুসরণ করার বিষয়ে হতে হবে কঠোর। ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি নিতে হবে জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ। ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজে উপযুক্ত প্রযুক্তি ছাড়াও দরকার পরিকল্পিত নগরব্যবস্থা গড়ে তোলা। এসবই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির রক্ষাকবচ। এখানে উদাসীনতা ও অবেহেলার কোনো সুযোগ নেই। সমন্বিত প্রচেষ্টায় রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ শহরকে যতটা সম্ভব ভূমিকম্প সহনশীল করে গড়ে তুলতে হবে।