

কৌতূহল, রহস্য ও নানারকম সৌন্দর্যে ভরা সৃষ্টিকর্তার বিশাল সৃষ্টি জগৎ। এসব সৃষ্টি মানুষকে আকৃষ্ট করে, আবার কোনো কোনো সৃষ্টি মানুষকে অবাক করে। সৃষ্টিকর্তার তেমনই এক আকৃষ্ট ও অবাক করার মতো চোখজুড়ানো সৃষ্টি অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতি। পৃথিবীতে অসংখ্য নাম ও রঙের নকশাখচিত প্রজাপতি রয়েছে।
আমাদের আশপাশের প্রকৃতি ঘিরে ওড়াউড়ি করে এসব প্রজাপতি। এসব প্রজাপতির দোদুল্যমান নৃত্য আকৃষ্ট হওয়ার মতো মনোমুগ্ধকর। প্রজাপতির উপস্থিতিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন আরও ঢের গুণ বৃদ্ধি পায়। এদের উপস্থিতিতে প্রকৃতি বেশ মায়াময় হয়ে ওঠে।
প্রজাপতি শুধু সৌন্দর্য বা শোভা বৃদ্ধিই করে না, জীববৈচিত্র্যের ভান্ডারে প্রজাপতির রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও পরিবেশগত ভারসাম্যে ভূমিকা রাখার সঙ্গে সঙ্গে পরাগায়নের মাধ্যমে উদ্ভিদের বিস্তারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি। প্রকৃতি ও প্রজাপতি যেন একে অপরের পরিপূরক। শুধু তাই নয়, অনন্য সৌন্দর্যের জন্য প্রজাপতির প্রতি অনাদিকাল থেকে মানুষেরও রয়েছে এক বিশেষ ধরনের আকর্ষণ ও ভালোবাসা।
চোখজুড়ানো তেমনই এক নকশাখচিত অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতি চাঁদনরি খালের পাশের ঝোপ ঘিরে ওড়াউড়ি করছিল। ওড়াউড়ির ফাঁকে ফাঁকে বসছিল ফুলে, পাতায় ও সরু ডালে। কিছু সময় পর একই প্রজাতির আরও দুটি প্রজাপতি এসে যোগ দিল প্রজাপতিটির সঙ্গে। এবার একই প্রজাতির তিনটি প্রজাপতির উপস্থিতিতে পরিবেশটা যেন অন্যরকম সুন্দর হয়ে উঠল। এরা উড়ন্ত অবস্থায় খুনসুটি করছিল একে অপরের সঙ্গে। আবারও বসছিল ফুলে, পাতায় ও ডালে। এ দৃশ্যে যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করেছিল।
এমনই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা গেছে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের মহালক্ষীপাড়া গ্রামের এক খালের পাড়ের ঝোপে। প্রজাপতিদের রঙিন ডানার ঝাপটায়, নৃত্যে ও খুনসুটিতে সেখানকার পরিবেশ হয়ে উঠেছিল মনোমুগ্ধকর। এ দৃশ্য ছিল মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতো সুন্দর ও চোখজুড়ানো।
জানা গেছে, চোখজুড়ানো অনন্য সুন্দর প্রজাপতি চাঁদনরির বৈজ্ঞানিক নাম জুনোনিয়া অ্যাটলাইটস। এরা নিম্ফ্যালিডি পরিবারের সদস্য। লেপিডোপ্টেরা বর্গের এ প্রজাপতির ইংরেজি নাম গ্রে প্যানসি। এই প্রজাতির প্রজাপতির বাংলা নাম ধূসর শিখীপর্ণ, চাঁদনরি। তবে চাঁদনরি নামটি পশ্চিমবঙ্গে বেশি ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও এটিকে কেউ বলে ধূসরাক্ষী বা ধূসর-সোনালি চক্র প্রজাপতি। এদের পুরুষ প্রজাতির চেয়ে নারী প্রজাতি আকারে বড় হয়।
এই প্রজাপতির মূল শরীর ও ডানা ধূসর খয়েরি রঙের। এদের ডানার উভয় প্রান্তে চাঁদমালা আঁকা, আর এ কারণেই এই প্রজাতির প্রজাপতির নামকরণ করা হয়েছে চাঁদনরি। এদের বড় বৃত্তগুলোর মাঝখানে কালো ও কমলা রঙের ছোপ রয়েছে। এদের ডানার চাঁদমালার বাইরের দিকে খয়েরি পাড় রয়েছে। এদের ডানার উপরিতল ধূসর এবং কালচে বাদামি ও হালকা বাদামি দাগ ও রেখা দ্বারা চিত্রিত। ডানার সম্মুখপ্রান্ত থেকে কয়েকটি আঁকাবাঁকা খয়েরি রেখা কিছুটা নিচের দিকে নেমে এসেছে। পেছনে ডানা সামনে ডানার অনুরূপ রেখা, দাগ, ছোপ, বন্ধনী ও চক্ষু বিন্দুযুক্ত। বেসাল অংশের বাইরের দিকে কালো রেখাবৃত দুটি ছোট ও অস্পষ্ট ধূসর রঙের সংযুক্ত ছোপ থাকে। এদের ডানার আকার ৫৫ থেকে ৬৫ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
চাঁদনরি প্রজাপতিদের সাধারণত জলাশয়ের কাছাকাছি ঝোপ বা স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। এরা সকালবেলায় ডানা মেলে বা আধবোজা অবস্থায় গাছের পাতা বা মাটিতে বসে রোদ পোহায়। এরা ওড়ার সময় ডানায় ছোট ছোট ঝাঁকি দিতে দিতে ওড়ে। তবে এরকম ঝাঁকি কয়েকবার দিয়েই ডানাগুলো টান করে মেলে ধরে আকম্পিতভাবে শূন্যে ভেসে চলে। তবে প্রচুর বৃষ্টিপ্রবণ খোলা জায়গায় এরা বিচরণ করতে বেশি পছন্দ করে। পুরুষ প্রজাতির নির্দিষ্ট এলাকা থাকে। এরা উড়তে উড়তে খুব বেশি ওপরে ওঠে না। মাটির কাছাকাছি বিচরণ করতে বেশি পছন্দ করে। প্রয়োজনে এরা দ্রুত উড়তে পারে।
এদের শূককীট বা পিউপার রং ধূসর বাদামি। এই প্রজাপতির ডিম গোলাকার সবুজ বর্ণের। এতে ১২টি খাঁজ থাকে। ডিম থেকে ৩ দিন পর বাচ্চা বের হয়। এদের বাচ্চারা পাতা খায়। এদের জীবনচক্র শেষ হতে সময় লাগে ২০ থেকে ৩২ দিন। এদের জীবনচক্র লাল বেরেলা, করম্বল ও লজ্জাবতী পোষক গাছে ঘটে। এ দেশে এদের সারাবছরই দেখা যায়। এ ছাড়া এ প্রজাতির প্রজাপতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, দক্ষিণ চীন, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এদের দেখা যায়।
চাঁদনরি প্রজাপতি অন্যান্য প্রজাপতির মতোই তরল খাবার খায়। বিশেষ করে এদের খাবার তালিকার প্রিয় স্থানে রয়েছে বিভিন্ন ফুলের মধু। এরা এদের নলের মতো শুঁড় দিয়ে মধু গ্রহণ করে। এ ছাড়া এরা পাকা বা পচা ফলের রস, কাদা এবং গাছের রস খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা কালবেলাকে বলেন, ধূসর শিখীপর্ণ বা চাঁদনরি প্রজাপতি দেখতে খুব বেশি বর্ণিল না হলেও দেখতে বেশ সুন্দর। এ প্রজাপতি খুব বেশি উপরে না ওঠার কারণে সচরাচরই চোখে পড়ে। বিশেষ করে এদের জলাশয়ের আশপাশের প্রকৃতিতে বেশি দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, ধূসর শিখীপর্ণ বা চাঁদনরি ছাড়াও অন্যান্য প্রজাপতিরা উদ্ভিদের পরাগায়নে সহায়তা করে থাকে। তবে এদের শুঁয়াপোকা গাছের পাতা খেয়ে জীবনধারণ করার কারণে গাছ বা ফসলের ক্ষতি হয়। তবে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাপতির ভূমিকা অপরিসীম।
মন্তব্য করুন