অনিকেত আহম্মেদ, সবাই অনি বলে ডাকে, তিরিশ ছুঁই ছুঁই এক চুপচাপ বইপ্রেমী যুবক, ঢাকা থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরছে। পাত্রী দেখতে গিয়ে আরেকবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ছেলে ভালো, কিন্তু জমে না। এ নিয়ে নয়বার। প্রতিবারই প্রতিজ্ঞা করে এবারই শেষ। গত মাসেও নাটোরে গিয়েছিল কিন্তু পাত্রী তাকে পছন্দ করেনি, তবে পাত্রীর বাবা-মা অবশ্য তাকে পছন্দ করেছিল। এই নিয়ে অনিকেতের মাও খুব বিরক্ত। প্রত্যেকবার পাত্রী দেখার সময় তার মা সঙ্গে থাকে, এবার বিরক্ত হয়ে মা সঙ্গে আসেননি। তবে মাঝেমধ্যে তার ছোট ভাই মামুনও গিয়েছে তার সঙ্গে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, সব পাত্রীকেই অনিকেত পছন্দ করে। এ বিষয়ে তার দর্শন হলো—মেয়েরা মাতৃজাত, তাদের অপছন্দ করতে নেই। অনিকেতের বাবা বেঁচে নেই। বাবা জামিল সাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো এতবার ফিরে আসতে হতো না। জামিল সাহেব প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এলাকায় সবাই তাকে মান্য করত।
হঠাৎ ট্রেনটা থেমে গেল এক প্রায় পরিত্যক্ত স্টেশনে। নাম দুর্গাপুর। এক সময়ের প্রাণচঞ্চল এক স্টেশন। স্টেশনের ছাউনির নিচে একটি বেঞ্চ, পাশেই পরিপাটি ছোট্ট চায়ের দোকান। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। চারদিকে কৃষ্ণচূড়ার গাছ। অনি জানালার ধারে বসে বই পড়ছিল কিন্তু পৃষ্ঠা এগোচ্ছিল না। আজ তার মন উদাস হয়ে আছে। দুর্গাপুর নামটি যেন সে ঠিকভাবে শুনেছে বলেও মনে হয়নি। তবে এ জায়গাটার নাম তার ভেতরে কোথাও থমকে গেল।
ওই চায়ের দোকানটি চৈতীর, এক পায়ে আলতা, মুখে হালকা হাসি, গলায় রবীন্দ্রসংগীতের সুর। সে ব্যতিক্রম। চা বানায়, গান গায় আর মাঝেমধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে। এলাকার লোকজন সবাই জানে চৈতী একটু এলোমেলো। আলতাফের মেয়ে চৈতী, আলতাফ অনেক আগেই মারা গিয়েছে।
শরৎপল্লী একবারেই ছোট গ্রাম। গ্রামের একমাত্র অহংকার হলো এই দুর্গাপুর রেলস্টেশন। একেবারে সীমান্তঘেঁষা। সব মিলিয়ে এখন গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় শ’তিনেক হবে। একসময় অনেক লোকে সমাগম ছিল, তখন দুর্গাপুর স্টেশন সরগরম ছিল। সীমান্তঘেঁষা গ্রাম হওয়ায় অধিকাংশ হিন্দুলোকই দেশ ভাগের পর জমি এওয়াজ বদল করে সীমান্তের ওপারে ভারতে চলে যায়। ফলে শরৎপল্লীর শ্রী কিছুটা কমে যায়। এখন যারা গ্রামে বাস করে, তারা সীমান্তের ওপার থেকে এসেছে। কারও অবস্থাই খুব একটা ভালো নয়। চা খাওয়ার লোভে ট্রেন থেকে নেমে আসে অনি। দোকানের সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে মেয়েটিকে। হালকা গড়নে নীল সালোয়ার কামিজ পরা গোছালো চুলের এক তরুণী। চোখে শান্ত ছায়া, কপালে নীল টিপ। সে কেটলি থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকা চা ঢালছে কাচের কাপগুলোতে।
অনি দোকানের সামনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি তাকে দেখে হাসে। বলেও ফেলে একটা চা দেব? অনি একটু চমকে যায়। নিজের মনের অজান্তেই বলে ফেলে, দাও। চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় চৈতী। সেইসঙ্গে অনির চোখ ধরা পড়ে মেয়েটির বাঁ হাতে ধরা একটি বইয়ের পাতা আধভাঙা, তবু বোঝা যায় কবিতা। অনি জিজ্ঞেস করে, তুমি পড়ো? মেয়েটি তার চেয়ে তিন-চার বছরের ছোট হবে। তাই তুমি করেই বলে ফেলল। মেয়েটি তাকায়। চোখে তির্যক হাসি।
চা-ওয়ালারা কি পড়তে পারে না?
তা পারে। আমি শুধু ভাবছিলাম—
কী ভাবছিলেন? চা নিয়ে গল্প লিখবেন? আপানার চোখের চাহনি দেখে আপনাকে তো সাহিত্যিক সাহিত্যিক মনে হয়।
অনি হেসে ফেলে। মিষ্টি এক হাসি।
তুমি নাম বলো। আমি লিখি।
আমি লিখি না, পড়ি। নাম চৈতী।
আমি অনি।
দুজনই মাথা নেড়ে চা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চায়ের ধোঁয়া উঠে যায় বাতাসে, তাতে কোনো তাড়াহুড়া নেই।
ততক্ষণেও ট্রেন ছাড়ে না। স্টেশন মাস্টার জানান, লাইনে জট। পরবর্তী আপ ট্রেন এক ঘণ্টা পর। অনি অপেক্ষা করতে থাকে আর মনে মনে ভাবে ভালোই হলো। এর মধ্যে অনি মায়ের কথা চিন্তা করে, মা বসে থাকবে তার অপেক্ষায়। অনি না ফেরা পর্যন্ত তার মা ভাত খাবে না। কিন্তু আপ ট্রেন আসলেই শুধু ট্রেন ছাড়বে। চৈতী তখন পিঠের চুল ঠিক করছে।
তোমার বাড়ি কি পাশেই?
হ্যাঁ। আমার বাড়ি স্টেশনের পাশে শরৎপল্লী গ্রাম। আমি বাংলায় অনার্স করতাম বঙ্কু বিহারী কলেজে। বাবার মৃত্যুর পর ফিরতে হয়েছে। সংসারের হাল ধরার জন্য বই ছেড়ে কেটলি ধরেছি। কথা শেষ করে আর কিছু বলল না। অনি চুপ করে বসে আছে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে। ট্রেনের দেরি দেখে চাপ্রেমীরা অনেকেই নামছেন চা খাওয়ার জন্য। খুব বেশি দোকান নেই এই স্টেশনে। চৈতীর দোকান ছাড়া একটা মুদির দোকান আর অন্যান্য দুই-তিনটি দোকান। অনি বারবার চৈতীর চোখে তাকায়। চৈতীও তা লক্ষ করে।
এই মেয়েটার চোখে সরে যেতে থাকা কোনো আলো যেন ধরে রাখতে চায় সে।
তুমি কি আবার লেখাপড়ায় ফিরতে চাও?
একসময় চেয়েছি, এখন আর ভাবি না। লোকাল ট্রেন ছাড়া এই স্টেশনে অন্য কোনো ট্রেন থামে না। কিন্তু আমার ট্রেন থেমে গেছে।
কথাগুলো এমনভাবে বলা, যেন খুব সোজা। কিন্তু সোজা নয়। ভেতরে কাঁটা লুকোনো। অনির চোখ ঘোরে সারা স্টেশনে। আলো ঝিমিয়ে আসে। চৈতীর গলার স্বর হঠাৎ ধীরে গেয়ে ওঠে, হে ক্ষণিকের অতিথি এলে প্রভাতে। অনির মনে হয় এই স্টেশনটা, এই সন্ধ্যাটা, এই গলা সব যেন আগে শোনা, অথচ কোথাও লেখা ছিল না।
সময় গড়ায়। চৈতীর চায়ের দোকানে পাড়ার একটি ছেলে কাজ করে, নাম পটল। পটলকে রেখে তারা প্ল্যাটফর্মে হাঁটে। একটা খালি বেঞ্চে বসে। চুপচাপ।
তুমি কি বিশ্বাস করো, এক বিকেলে দুজন একে অন্যকে এমন চিনতে পারে?
চৈতী মাথা নেড়ে বলে, আগে বিশ্বাস করতাম না, এখন করি। এক বিকেল অনেক বেশি সময়। তারা দুজনই হাসে। এই হাসি উদ্ভট নয়, শুদ্ধ। কিছুক্ষণ পর হুইসেল বাজে। অনি উঠে দাঁড়ায়। চৈতীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু একটা শব্দও খুঁজে পায় না।
তোমাকে খুঁজে পাব কী করে?
আমি তো বললাম, আমার নাম চৈতী। নামটা মুখস্থ থাকলে ফিরে আসবেন। এই চায়ের দোকানে, বলবেন চৈতী আছে?
সে দাঁড়িয়ে থাকে। অনিকেত ধীরে ধীরে হেঁটে উঠে পড়ে ট্রেনে। তার পা যেন চলতে চায় না, এক অদৃশ্য সুতার জালে আটকা পড়তে চায়। অনি জানালার ধারে তার সিটে বসে। বাতাসে চৈতীর মুখচ্ছবি এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে। ট্রেন ছুটে চলে। আস্তে আস্তে দুর্গাপুর যেন স্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে থাকে। পার্থিব জীবনের সবকিছুই হারিয়ে যায় শুধু স্মৃতি ভোরের আলোর মতো উঁকি দেয় জীবনের পরতে পরতে।
মন্তব্য করুন