আমার জীবনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পৃথিবীর বহু দেশে যাওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ বিলেত-আমেরিকার দিকেই যায়, তবে সেসব জায়গা আমার কাছে এখন মামুলি মনে হয়। কিন্তু আমি যে দুনিয়াটা দেখতে পেরেছি, তা দেখার সুযোগ হয়তো সবার কপালে জোটে না। সে কারণে জাতিসংঘের যে চাকরিটা আমি করতাম তার প্রতি কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ আমি আফ্রিকায় গেছি।
উনিশশো নব্বই থেকে ছিয়ানব্বই সালে আমি একাধিকবার আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গিয়েছি, কাজ করেছি, থেকেছি। সে কারণে আফ্রিকা সম্পর্কে আমার সামান্য কিছু ধারণা আছে এবং আমি যখন আফ্রিকায় যাই, তার পটভূমিটা হচ্ছে ওই সময়ে বিশ্বব্যাপী এইডস রোগটা ছড়িয়ে পড়ছিল। আমি যেহেতু বাংলাদেশের পর্যায়ে এই এইডস নিয়ে কাজ করেছিলাম, বিশেষ করে আমার কাজের যে ধরন—সমাজ বা কমিউনিটিভিত্তিক অর্থাৎ কীভাবে একটা জনগোষ্ঠী নিজেকে রক্ষা করে এবং বাংলাদেশ যেহেতু এ কাজে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছে, বিশেষ করে টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে—সে কারণে তারা বাংলাদেশের কর্মীদের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিল। এর মাধ্যমেই আমার আফ্রিকায় যাওয়ার ঘটনাটি ঘটে।
উনিশশো তিরানব্বই সালে আমি জাতিসংঘের চাকরিটা ছেড়ে দিই এবং দেশে ফিরে ফ্রিল্যান্সার হয়ে যাই। তবে পরের বছর আমি চাকরি শুরু করি বিবিসিতে। ফুলটাইম চাকরি না ঠিক, যদিও আমি ওদের রিপোর্টার ছিলাম। কিন্তু ততদিনে বাংলাদেশের রাজনীতি আমাকে খুব ক্লান্ত করে ফেলেছে। সেই ক্লান্তি এখনো যায়নি; যদিও সারাক্ষণ না হলেও ওগুলো নিয়ে এখনো মাঝেমধ্যেই লিখতে হয়। তো বিবিসিতে কাজ করার সময় আমি আবার আফ্রিকায় যাওয়ার একটা অফার পাই। তারপর আবার যাই আফ্রিকা। চুরানব্বই থেকে ছিয়ানব্বই আমি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছিলাম। মূলত জাতিসংঘই আবার আমাকে হায়ার করে নিয়ে গিয়েছিল।
নাইজেরিয়ায় আমি ছিলাম বহুদিন। উগান্ডায়ও বেশ কিছুদিন ছিলাম। আর ছিলাম ইথিওপিয়ায়। এ তিনটা দেশেই মূলত ছিলাম আর অন্য দেশগুলোতে মাঝেমধ্যে যাওয়া পড়েছে। যেহেতু বহুদিন ছিলাম এবং অনেক জায়গায় গিয়েছি, বিশেষ করে নাইজেরিয়া, উগান্ডার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং ইথিওপিয়ার শহরাঞ্চলে—আমার ওদের দুনিয়াটা দেখা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, পৃথিবীতে এত কষ্টের মধ্যে যে মানুষ থাকতে পারে তা আমরা অনেকে ভাবতেও পারব না। এ ধরনের কষ্টের মধ্যে মানুষগুলো কীভাবে যে খাপ খাইয়ে নেয়, ভাবা যায় না!
নাইজেরিয়া খুব বিশৃঙ্খল একটা দেশ। বিশেষ করে তিরানব্বই-চুরানব্বইয়ের দিকে ভয়াবহ অবস্থা তাদের। তবে আমার খুব সহজ লাগত। কারণ আমি নিজেও তো খুব বিশৃঙ্খল মানুষ। সে জন্যই বোধহয় নাইজেরিয়ার মানুষদের সঙ্গে আমার খুব সহজেই মিলে যেত। সেখানকার মানুষের অবস্থা কত খারাপ হতে পারে, তা সত্যি কল্পনার অতীত। তবে বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বড় দেশ নাইজেরিয়া। সে কারণে তাদের জীবনবৈচিত্র্যও ব্যাপক।
আমি দেশে ফিরে এসে যখন লিখেছিলাম, নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত একবার আমার ওপর খুব রাগ করেছিলেন; কিন্তু আমি তেমন কোনো খারাপ কথা বলিনি। এবং মনে করি যে আমি কিছুটা হলেও নাইজেরিয়ান। ওখানকার মানুষজনও বলত যে, তুমি ঠিক সাউথ এশিয়ার লোকদের মতো না, ওরা তো অন্যরকম হয়। আমি বুঝি কেন ওরা এটা ভাবত। কারণ আমার তো কালো মানুষের প্রতি কোনো খারাপ লাগা ছিলে না। আমি ভদ্র, ওরা ভদ্র না—এরকম কোনো ধ্যান-ধারণাও আমার মধ্যে ছিল না। যার ফলে ওরাও সহজভাবেই নিয়েছিল আমাকে। তবে আরেকটা বিষয় হলো, নাইজেরিয়ানদের সঙ্গে বাঙালি বা বাংলাদেশিদের মিল প্রবল। বাঙালিরা যেমন বাটপারি করে চলে, নাইজেরিয়ানরাও কিন্তু বাটপারি করে চলে। এই যে প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললে এত এত চুরি-বাটপারির খবর দেখা যায়, নাইজেরিয়ানরাও কিন্তু তাই। ওরা যে কত কিসিমের দুই নম্বরি করে তা চিন্তা করা যায় না! সে বিষয়গুলো নিয়ে আমি পরে একসময় বলব যে, কী পরিমাণ দুই নম্বরি লোকে ভরা একটা দেশ নাইজেরিয়া। কিন্তু এ অবস্থাটা কেন, সেটা আমি বুঝতে পারি। ওদের জীবনে বের হয়ে যাওয়ার, পালাবার, টিকে থাকার, মুক্ত হওয়ার পথগুলো অনেক সীমিত। বাটপারি ছাড়া সেখানে কোনো উপায় নেই এবং তারা এ সুযোগটাই নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে যারা বাটপার বা এখন আমাদের দেশে যারা বাটপার, তাদের বাটপারিটা না করলেও চলে; তারা করে বড়লোক হওয়ার জন্য, আরও ভালো থাকার জন্য। নাইজেরিয়ায় যারা বাটপারি করে তারা কিন্তু টিকে থাকার জন্য, বাঁচার জন্য বাটপারিটা করে। অবশ্য এটাও ঠিক, বাংলাদেশে অনেক সাধারণ মানুষও আছে যারা বাটপারিটা করে।
উগান্ডা একটা অদ্ভুত দেশ। আমি এত দেশে গেছি, দেখেছি—উগান্ডার মতো এমন বন্ধুবৎসল দেশ পৃথিবীতে নেই। পশ্চিমারা খুব ভদ্রভাবে হিসাব করে বন্ধুবৎসল হয়, বিশেষ করে ইউরোপে, তবে ওখানে তো বর্ণবাদ প্রচণ্ড প্রবল। কিন্তু উগান্ডার মানুষ এত সহজ-সরলভাবে বন্ধুপূর্ণ, না মিশলে ধারণা করা যাবে না। উগান্ডার খুব দারুণ দারুণ স্মৃতি আছে আমার। আবার খুব ভয়াবহ স্মৃতিও আছে, কারণ রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় আমি ওখানে ছিলাম, কাজ করছিলাম। তখন আবার দেখেছি মানুষ যে কী নিষ্ঠুর হতে পারে! প্রচুর লাশ দেখেছি। আবার একই সঙ্গে আমি ওদের মানবিকতাটাও দেখেছি।
ইথিওপিয়া দেশটা হচ্ছে এই সবকিছু থেকে ভিন্ন। সমগ্রটা মিলিয়ে বলা যায় সেটা একটাই দেশ। কিন্তু আফ্রিকার প্রত্যেকটা দেশ ধরে ধরে জোর করে রাষ্ট্র বানানো হয়েছে। বাস্তবে এগুলো এক রাষ্ট্র নয়। একাধিক রাষ্ট্র ধরে একটা করে দেশ বানানো হয়েছে। সেখানে নাইজেরিয়ায় যেমন গোলমাল লেগেই আছে; যেখানেই যেতাম শুনতাম সেখানে রায়ট হয়েছে। সেখানে খ্রিষ্টান আর মুসলমানদের মধ্যে রায়ট হয়, পূর্বের আর পশ্চিমের মানুষদের মধ্যে রায়ট হয়, উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের লোকজনদের রায়ট হয়। মারপিট, খুন, জখম চলছেই। কারণ তারা তো এক না! ওই দেশে নিয়ম করে রাজনৈতিক দল বন্ধ করে দিয়েছিল একসময় যে, সাতটার বেশি রাজনৈতিক দল থাকতে পারবে না। ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলো মিলে একটা বড় দল বানায় ওরা। অতএব এগুলোকে এক বানানোর চেষ্টা বা প্রবণতাটা ভয়াবহ। এটা ঐতিহাসিকভাবে এতই ক্ষতিকারক যে, চিন্তা করা যায় না। উগান্ডা তো নিশ্চিতভাবেই একটা দেশ নয়। আমার মনে আছে, উগান্ডায় একবার মাঠপর্যায়ে কাজ করতে যাচ্ছি। যে গাড়িতে যাব সে গাড়িওয়ালা আমাকে বলছে, বস আমি কিন্তু অর্ধেক পেট্রোল নিয়েছি, তোমাকে বলে রাখলাম, তুমি চিন্তা করো না। আমি বললাম, কেন! লোকটা বলল যে, ‘এখানে অনেক সময় ডাকাতের আক্রমণ হয়, গাড়ি ছিনতাই হয়ে যায়; অফিস থেকে বলা আছে যেন অর্ধেক পেট্রোল ভরা হয়, যাতে গাড়ি নিয়ে বর্ডার পার হতে না পারে।’ চিন্তা করা যায়! কত বিচ্ছিন্ন একটা দেশ! বাংলাদেশ নিয়ে আমি এত অপ্রাতিষ্ঠানিকতার কথা বলি, কিন্তু এখানে যে কোনো সময় যে কোনো জায়গা থেকে আমি যোগাযোগটা অন্তত করতে পারব। কিন্তু উগান্ডায় সেটা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত হচ্ছে ইথিওপিয়া। আমি শেষবার যখন ইথিওপিয়ায় গেলাম, আমি যখন এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছি, ওদের গৃহযুদ্ধ তখনো চলছে বা শেষের দিকে। আদ্দিসআবাবা তখন দখল হয়ে গেছে। পৃথিবীর শহুরে মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এইচআইভি পজিটিভ ছিল তখন ইথিওপিয়ার মানুষদের। সে সময় দেখেছি, সেখানকার এয়ারপোর্টটা একপক্ষের হাতে, শহরটা আরেকপক্ষের হাতে। আর সেনাবাহিনী রয়েছে তৃতীয় কোনো লোকের হাতে। এরকম পরিস্থিতিতে ইথিওপিয়ায় গিয়েছি। [পরের কিস্তি এক সংখ্যা পর]
মন্তব্য করুন