ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলকে পূর্ণ পেশাদারি রূপ দিতে ২০২১ সালে ক্লাবগুলোকে লিমিটেড কোম্পানি গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। এটি কিছু ক্লাবের জন্য সুফল বয়ে আনলেও অনেক ক্লাবের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ব্রাজিলের অম্লমধুর অভিজ্ঞতায় আর্জেন্টিনা এখন ভাবছে—কোন পথটি আসলে সঠিক?
ব্রাজিলের ফুটবল ঐতিহ্যগতভাবে আর্জেন্টিনার বিপরীতধর্মী। যেখানে আর্জেন্টাইনরা ত্যাগ, সংগ্রাম ও হৃদয়ের মূল্য দেয়, সেখানে ব্রাজিল ফুটবলে খুঁজে পায় আনন্দ, ছন্দ ও শৈল্পিকতা। একটি জায়গায় দুই দেশের মিল রয়েছে—তাদের ফুটবল ইউরোপের শৃঙ্খলাবদ্ধ ধারার বিপরীত। এখানে খেলাটি ব্যক্তিগত প্রতিভা ও প্রকাশভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। উরুগুয়ের সঙ্গে আর্জেন্টিনার বন্ধুসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও ব্রাজিলকে তারা দেখে প্রকৃত প্রতিপক্ষ হিসেবে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও, দুই দেশই এখন এমন একটি বিদেশি ক্লাব ব্যবস্থাপনার মুখোমুখি, যেখানে ফুটবলের ব্যবসায়িক দিকই মুখ্য। ২১ শতকে ফুটবলের বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা খেলাটির নিজস্বতাকে সংকটে ফেলেছে। ইংরেজ ক্রীড়া সাংবাদিক জোনাথন উইলসন লিখেছেন, ‘কমিউনাল পরিচয়ও এখন পণ্য হয়ে গেছে, যা কেনাবেচা ও শোষণের উপকরণ।’
আর্জেন্টিনায় প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই স্পোর্টিং আইনে সংশোধনী এনেছেন, যা ব্যক্তিগত ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে। আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন দৃঢ়ভাবে চাইছে, ক্লাবগুলো যেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই থাকে। ব্রাজিলে ফুটবলের জন্য লিমিটেড কোম্পানি আইন চালু হয় ২০২১ সালে, প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর সময়। এই আইনের মাধ্যমে ক্লাবগুলোর ঋণ ও দুর্নীতির সমস্যা সমাধানের জন্য কর সুবিধা দেওয়া হয়। এই আইনে ক্লাব সদস্যরা ভোট দিয়ে একটি স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতে পারেন, যা শুধু পেশাদার ফুটবল কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ক্লাবের অন্যান্য সম্পদ ও কার্যক্রম অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের অধীনেই থাকবে।
লিমিটেড কোম্পানির কর হার মাত্র ৪ শতাংশ। মাসিক আয়ের ২০ শতাংশ ঋণ পরিশোধে, ২০ শতাংশ ক্লাবের ঐতিহ্য ও ব্র্যান্ডিংয়ে এবং বাকি অংশ খেলোয়াড় কেনা, বেতন ও অন্যান্য খরচে ব্যয় করার বিধান রাখা হয়েছে। এই মডেল গ্রহণ করেছে ব্রাজিলের শীর্ষ ৪০ ক্লাবের মধ্যে ১৪টি। এর মধ্যে ৬টি বর্তমানে ঘরোয়া শীর্ষ লিগে খেলছে। প্রথম যে ক্লাবটি লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়, সেটি ছিল ক্রুজেইরো। ক্লাবটি কিনে নেন বিশ্বকাপজয়ী সাবেক ফুটবলার রোনালদো নাজারিও। তার নেতৃত্বে ক্লাবটি আর্থিক স্থিতিশীলতা পায় এবং প্রথম বিভাগে ফিরে আসে।
অন্যদিকে, বোটাফোগো লিমিটেড কোম্পানি হয়ে সফলতা পেলেও, মালিক জন টেক্সটরের একক অর্থ ব্যবস্থাপনার কারণে ক্লাবটি ফ্রান্সের অলিম্পিক লিঁকে ১৪০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। বর্তমানে টেক্সটর তার হোল্ডিং কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কেম্যান দ্বীপে নতুন ফান্ড গঠন করেছেন, যা আইনি জটিলতায় ফেলেছে বোটাফোগোকে। ভাস্কো
দা গামা লিমিটেড কোম্পানি হয়ে আমেরিকান বিনিয়োগকারী ‘৭৭৭ পার্টনার্স’-এর কাছে ৭০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে। কিন্তু বিনিয়োগ না আসায় ক্লাবটি মামলা করে এবং শেষ পর্যন্ত লিমিটেড কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
লিমিটেড কোম্পানি মডেল ব্রাজিলীয় ফুটবলে সোনালি যুগ এনেছে কি না—বলা কঠিন। মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায় ব্রাজিলের ক্লাবগুলোর আধিপত্য থাকলেও, সাফল্য পাওয়া ক্লাবগুলোর মধ্যে একমাত্র লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত ক্লাব ছিল বোটাফোগো। সবচেয়ে সফল ক্লাব দুটি—পালমেইরাস ও ফ্ল্যামেঙ্গো কিন্তু এখনো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচালিত হচ্ছে।
ক্লাবগুলোকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করার মডেল আর্জেন্টিনার জন্য কী বয়ে আনবে—বলা মুশকিল। কারণ ব্রাজিলের তুলনায় আর্জেন্টিনার ফুটবল অর্থনীতি অনেক দুর্বল। ২০২৫ সালের আর্জেন্টাইন লিগ জয়ীর জন্য পুরস্কারের অঙ্ক মাত্র ৫ লাখ ডলার, যেখানে ব্রাজিলের শীর্ষ লিগ বিজয়ীর পুরস্কার ১৩.৮ মিলিয়ন ডলার!
ভাস্কো ও বোটাফোগোর অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে—ভুল বিনিয়োগকারী ক্লাবকে বিপদে ফেলতে পারে। আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলো বিনিয়োগের অভাবে ভুগছে। কিন্তু ব্রাজিলের মতো একই মডেল গ্রহণ করলে ক্লাবগুলোর বিপর্যয়ও ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
মন্তব্য করুন