বিমানবন্দরের যে অংশে আগুন লেগেছে সেখানে আমদানি করা সব ধরনের মালামালের গুদাম। দুপুরেই আড়াই টন আমদানি করা গার্মেন্টস পণ্য নামিয়েছে কুরিয়ার কোম্পানি তামিম এক্সপ্রেস লিমিটেড। এসব মালের সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে শঙ্কা জানালেন কোম্পানিটির পরিচালক সুলতান আহমেদ।
কার্গো কমপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘শনিবার হাফ শিপটিং কার্যক্রম চলে কার্গো কমপ্লেক্সে। সকাল ৯টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত খোলা ছিল। আমাদের কোম্পানির আড়াই টন মাল নেমেছে। সব পুড়ে গেছে নিশ্চিত।’ কোন ধরনের মালামাল ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব গার্মেন্টস আইটেম মাল ছিল। বাটন, জিপার ফেব্রিকস ও বিভিন্ন লেভেল আইটেম।’
কুরিয়ারের মাস্টার ইয়ার কোম্পানির সিএনএফ এজেন্ট মো. রোকন মিয়া বলেন, ‘প্রতিদিন টন টন মাল কার্গো হয়ে আসে। এই ঘটনায় বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে ব্যবসায়ীরা। স্কাই লাউঞ্জে কেমিক্যাল, ফেব্রিক, মেশিনারিজসহ সব ধরনের মালামাল রাখা হয়। আমাদের ধারণা কেমিক্যাল থেকেই আগুন লেগেছে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।’
দাঁড়িয়ে লেলিহান আগুনের দিকে ইমপোর্ট সেকশনে কাজ করা একজন কর্মী সোহেল মিয়া বলেন, ‘আট নাম্বার গেটের সঙ্গে লাগানো কুরিয়ার সার্ভিসের গোডাউন, এরপর ফার্মাসিউটিক্যাল ও ভ্যারাইটিজ পণ্যের গোডাউন। মাঝখানে কুল রুম, ডেঞ্জারাস গুডসের গোডাউন অর্থাৎ এই গোডাউনে বিস্ফোরকদ্রব্য রাখা হয়। এরপর আমদানি করা মোবাইলের গোডাউন। সর্বশেষ এবং বিজিএমই-এর গোডাউন। যেখানে পোশাক কারখানাগুলো রপ্তানি করার জন্য তাদের তৈরি করা মালামাল রাখে।’
আগুনের ভয়াবহতা নিয়ে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ডেঞ্জারাস গুডসের গোডাউনে আগুন লেগেছে। সেখানে রাখা বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো বিকট আওয়াজ করে ফুটছিল। এই আগুন সহজেই নেভানো যাবে না। কারো পক্ষে এটা নেভানো সম্ভব না, যদি নিজে থেকে না নেভে। কারণ, ডেঞ্জারাস গুডস গোডাউনে পানি দিলেও আগুন নিভবে না।’
শনিবার বিকেল আড়াইটার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমদানি কার্গো ভিলেজে আগুন আগে। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত থেমে থেমে আগুন জ্বলছিল। সরজমিন দেখা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা লেডারের সাহায্যে আগুনে পানি দিচ্ছিলেন। এদিকে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্যরা আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করছিলেন। আগুন কার্গো ভিলেজের পুরো ভবনে ছড়িয়ে যায়।
এদিকে আগুন লাগার পর বিমানবন্দরে সব ফ্লাইট ওঠানাম বন্ধ রয়েছে। বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালকের মুখপাত্র মো. মাসুদুল হাসান মাসুদ এই তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
ঘটনাস্থলে ঢাকার ১৩টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সন্ধ্যার পর থেকে কার্গো ভিলেজের পাশে কুরিয়ার সার্ভিসের আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়। বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের (হ্যাঙ্গার গেট) পাশে দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন। এই আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। তবে, বিমানবন্দরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কার্গো ভিলেজে পাশে স্কাই ক্যাপিটাল (বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ করে) ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাঝের পয়েন্টে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। সেখানে কর্মরত সদস্যরা আগুন দেখে দ্রুত বের হতে শুরু করেন। এরপর তারা বিভিন্ন জায়গাতে ফোন করে বিষয়টি জানান। এরপর কার্গো ভিলেজের সামনে যেসব উড়োজাহাজ ছিল সেগুলো দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের স্কাই ক্যাপিটাল লাউঞ্জ থেকে আগুনের সূত্রপাত। ক্যাপিটাল লাউঞ্জ বিমানবন্দরের ৮ নাম্বার গেটের প্রবেশ পথের পাশেই অবস্থিত। শুরুতে আগুনের ধোঁয়া দেখা গেলে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীন ফায়ার স্টেশন আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু করে। এরপর নৌবাহিনীর একটি ইউনিট যোগ দেয়। কার্গো কমপ্লেক্সে অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ থাকায় মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ধাপে ধাপে যোগ হতে থাকে অতিরিক্ত ইউনিট ও টিটিএল গাড়ি। কিন্তু আগুনের বিস্তার ঠেকানো যায়নি। দাউ দাউ করে পুরো কার্গো কমপ্লেক্সে জ্বলতে থাকে আগুন। ঘটনাস্থলে আনা হয় অ্যাম্বুলেন্স। কয়েকজনকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে দেখা গেছে। কার্গো কমপ্লেক্সের কর্মীরা দাবি করেছেন, কেমিক্যাল থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
সরজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ৩য় টার্মিনাল থেকেই ধোঁয়ার বিশাল কুণ্ডলি আকাশ কালো করে ফেলেছে। সেনাবাহিনী প্রধান সড়কে আলাদা একটি লেন তৈরি করে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসার সুবিধার্থে। বিমানবন্দরের সব গেট ও এপিবিএন হেডকোয়ার্টারের বিপরীত পাশের গেট জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরে ৮ নাম্বার গেটেও সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড। ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও সেনাবাহিনীর, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়।
জানা যায়, আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের বাইরের অংশ গেট-বি। এই অংশে ফেব্রিকের মালামাল রাখা হয়। এর পাশেই এক্সপ্রেস ইউনিট কাস্টমস হাউস অফিস। যা কুরিয়ার অফিস নামে পরিচিত। ৩৫টি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আমদানি হয়ে আসা মালামাল খালাস হয় এই কাউন্টারের মাধ্যমে। এর পাশেই রয়েছে পাবলিক টয়লেট। এ ছাড়াও বাইরের অংশে রয়েছে কুরিয়ারের মালামাল নিতে আসা লোকদের ওয়েটিং রুম। এই ওয়েটিং রুমের পেছনের অংশেই স্কাই ক্যাপিটাল লাউঞ্জ। স্কাই লাউঞ্জের পাশে কেমিক্যালসহ সব ধরনের মালামাল রাখা হতো। এটির সাথে কাস্টম কর্মকর্তাদের একটি রেস্ট রুম রয়েছে। আর বি-গেটের বিপরীত পাশে কার্গো কমপ্লেক্সের এক নম্বর গেট। এই এলাকায় সব কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য রাখা হতো। এই ১ নম্বর গেটে এবং ওয়েটিং রুমের পেছনের অংশে সবচেয়ে বেশি আগুনের তীব্রতা দেখা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী বিমানবন্দরের বেল অর্ডার অপারেটর ওয়ালিদ বলেন, ২টার দিকে স্কাই লাউঞ্জে আগুনের ধোঁয়া দেখা যায়। তখন ভেতরে থাকা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এরপর নৌবাহিনীর একটি গাড়ি যোগ দেয়। এতেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মুহূর্তের মধ্যে আগুন পুরো কার্গো কমপ্লেক্সে ছড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে বেশ কয়েকটি এ্যাম্বুলেস ঢুকতে ও বের হতে দেখা গেছে।
মন্তব্য করুন