ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি অঙ্কন কেন্দ্র করে বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ডানপন্থি এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরোধ শুরু হয়েছে। তবে এই বিরোধ সরাসরি নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে টিএসসি অডিটোরিয়ামের পেছনের অংশে আন্দোলনকারীদের করা গ্রাফিতি মুছে সেগুলোর ওপর নিজেদের গ্রাফিতি অঙ্কন করেছে বামপন্থি সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ এবং তাদের একটি দেয়াল লেখনীর মাধ্যমে ‘ইসলাম ধর্মকে অবমাননা’ করা হয়েছে। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়নের দাবি, নিজেদের গ্রাফিতি আঁকানো সেই জায়গাগুলোতে আগে থেকেই তাদের দেয়াল লেখনী ছিল এবং একদল কার্টুনিস্ট আগের লেখা মুছে ফেলার পর তারাই এঁকেছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের দেয়ালে আরবি গ্রাফিতি আঁকায় সেটি মুছে কিছু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে বাম ছাত্র সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী আটকে রাখায় চটেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার পতনের পর ঢাবি ক্যাম্পাসের বেশ কয়েকটি জায়গার দেয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কন করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের কিছু নেতাকর্মী ও চারুকলার শিক্ষার্থীরা। তার মধ্যে টিএসসি অডিটোরিয়ামের পেছনের দেয়াল অন্যতম। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সেখানে আন্দোলন সংবলিত গ্রাফিতি অঙ্কিত ছিল, যা মুছে ফেলা হয়েছে। টিএসসিতে এক গ্রাফিতিতে দেখা যায়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একটি উক্তি লেখা হয়েছে—‘শুনো, ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যাইও না। পরে ফুলের নাম কি দিবা ফাতেমা চূড়া?’ এর নিচেই ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য চার ধর্মের মানুষের ছবি আঁকা হয়। এই গ্রাফিতিকে ধর্ম নিয়ে উসকানি, বিভেদ বা বিভাজনের চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শহীদ মিনার এলাকায় আরবিতে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি আঁকার সময় বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী এসে তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান এবং সেগুলো মুছে ফেলেন। পরে তাদের ঢাবির টিএসসি অডিটোরিয়ামে এনে কয়েক ঘণ্টা আটকে জেরা করতে থাকেন তারা। এ ঘটনা ধারণকৃত এক ভিডিওতে ছাত্রফ্রন্ট একাংশের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছায়েদুল হক নিশান ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেলসহ অন্যান্য বাম সংগঠনের অনেককেই তাদের সঙ্গে বেশ আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেখা গেছে। ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তানজীম উদ্দীন খানও ওই শিক্ষার্থীদের জেরা করেন বলে জানা গেছে। বাম সংগঠনগুলো বলছে, শহীদ মিনারের সামনের ওই দেয়ালটিতে মূলত ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বিভিন্ন গান, কবিতা, উক্তি ও ছবি আঁকা হয়, অন্যকিছু নয়। এজন্যই তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নের গ্রাফিতি অঙ্কন প্রসঙ্গে জাহেদ হাসান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম দলগুলোর দৌরাত্ম্য খুব বেড়ে গেছে হঠাৎ করে। ক্যাম্পাসের আন্দোলনকেন্দ্রিক যত চিকা, স্লোগান, গ্রাফিতি ছিল সব তারা মুছে তাদের দলীয় গ্রাফিতি, চিকা, স্লোগানে সয়লাব করে দিচ্ছে। এসব নিয়ে আওয়াজ তুলতে হবে। আমাদের শহীদদের রক্তস্নাত আন্দোলনের স্মৃতি যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মুছে দিচ্ছে তাদের বাধা দিতে হবে।’
কলাভবনের শ্যাডোতে শিল্পী এস এম সুলতান স্মরণে ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে আঁকানো এক গ্রাফিতির ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে মো. ফোজায়েল বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনের সব লেখনী, গ্রাফিতি মুছে দিল ছাত্র ইউনিয়ন। এত তাড়াহুড়া করে বিপ্লবের স্মৃতিগুলো মুছে ফেলার কি দরকার ছিল?’
আশিকুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বাম সংগঠনগুলো ধর্মকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের গ্রাফিতির উল্লেখযোগ্য অংশই ধর্ম নিয়ে। অথচ এই স্বৈরাচার হটানো কোনো ধর্মভিত্তিক আন্দোলন ছিল না, ছিল জনমানুষের মুক্তির আন্দোলন। তারা এই বিপ্লবকে ধারণ করে না। রাতারাতি এই বিপ্লবের গ্রাফিতি তারা মুছে ফেলল কীভাবে?’
ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সংসদের নিনাদ খান বলেন, ‘বুধবার টিএসসির বাইরের দেয়ালে মাওলানা ভাসানী ও ফিলিস্তিন-সংক্রান্ত দুটি গ্রাফিতি মুছে দেয় ক্যাম্পাসের বাইরের কিছু আর্টিস্ট গ্রুপ। দুটি গ্রাফিতিই ছাত্র ইউনিয়নের ছিল। খবর পেয়ে আমি ক্যাম্পাসের কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। এ সময় তাদের সব আর্টিস্টকে জানাই যে, বিপ্লবের সময়ের ও আগের ডকুমেন্টেশন কোনোভাবেই মুছা যাবে না। কিন্তু দেয়াল যেহেতু সাদা করেই ফেলা হয়েছে, তাই তখন আর কিছু করার ছিল না। এরপর আর্টিস্টরা ঢাবি চারুকলার কিছু শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে ফের গ্রাফিতি আঁকায়।’
ঢাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ বলেন, ‘আন্দোলনের সব স্মৃতি তো আমারও স্মৃতি। আমিও তো আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেয়ালে লিখেছি, রাস্তায় লিখেছি। আন্দোলনকারীদের গ্রাফিতি মুছে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাঈম বলেন, ‘শ্যাডোতে আমাদের গ্রাফিতি অনেকদিন আগেই আঁকা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের দেয়াল লিখন কর্মসূচির আগেই। আমরা আন্দোলন চলাকালে সাংগঠনিকভাবে অনেক গ্রাফিতি করেছি, আমরা কেন মুছব এসব?’
গালিব সিয়াম নামে এক ঢাবি শিক্ষার্থী ফেসবুকে লেখেন, ‘মাদ্রাসার ছাত্রদের করা বাংলা ও আরবি গ্রাফিতি মুছে দিলেন বাম ও মুক্তচিন্তক ভাইয়া-আপুরা। আরবি না হয় দিলেন, বাংলাটা কী দোষ করল ভাই?’
ইশরাত জাহান ইমু নামে একজন লিখেছেন, ‘এই মুহূর্তে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্তম্ভ শহীদ মিনারের বিপরীতে বাংলা ভাষায় লেখা ভাষা আন্দোলনের স্লোগান, কথাগুলো মুছে ভিন্ন ভাষায় গ্রাফিতি করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্র মনে হয়েছে।’
এ ব্যাপারে ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘শহীদ মিনারের সামনের দেয়ালে ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক বাংলা লেখাগুলো মুছে একটা গ্রুপ আরবিতে ক্যালিগ্রাফি করছিল। তখন গিয়ে তাদের বোঝালাম, এটি তো আসলে আমাদের উত্তরাধিকার। আমরা ’২৪ সাল অর্জন করেছি বলে তো ’৫২ সালকে ভুলে যেতে পারি না। তানজীম স্যারও তাদের বুঝিয়েছেন। পরে সেগুলো মুছে ফেলা হয়। তাদের আটকে রাখা হয়নি, বরং জানতে চাওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খানকে কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।