

পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার শপ লিমিটেড (এসএসএল) এবং বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জসহ অন্তত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান মিলে সাধারণ গ্রাহকের প্রায় ৩৫৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারসহ শীর্ষ কর্তারা একে অন্যের যোগসাজশে এই অর্থ আত্মসাতে জড়িত ছিলেন। অবৈধ আর্থিক লেনদেন ‘রিপোর্ট’ না করে উল্টো ২২ কোটি টাকারও বেশি কমিশন নিয়েছে এসএসএল। এমন অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠান দুটির ১২ জনকে অভিযুক্ত করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত
বিভাগ সিআইডি। জব্দের সুপারিশ করা হয়েছে সোহেল রানা এবং তার বোন সোনিয়া মেহজাবিনের ১৮ কোটি টাকার ফ্ল্যাট।
২০২১ সালের অক্টোবরে গুলশান থানায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ২৩২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছিল সিআইডি। ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও বীথি আক্তার, চিফ অপারেটিং অফিসার আমান উল্লাহ চৌধুরী, উপদেষ্টা মাসুকুর রহমান, পরিচালক সাবেক পুলিশ পরিদর্শক শেখ সোহেল রানাকে আসামি করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, ই-কমার্স ব্যবসার নামে
গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে ব্যবসায়িক লেনদেনের বাইরে নগদ উত্তোলন এবং ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে আসামিরা মানি লন্ডারিং
করেছেন। গ্রাহকের টাকা পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাবে গ্রহণ করার পরও পণ্য সরবরাহ না করে চক্রটি প্রতারণা করেছে।
প্রায় তিন বছর মামলাটি তদন্ত করে সিআইডি। তদন্তে ই-অরেঞ্জ, রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল, অল জোন এবং এসএসএল কমার্সের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। অভিযুক্তরা ৩৫৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে গত রোববার আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম শাখা থেকে সদ্য বদলি হওয়া মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জিল্লুর রহমান। প্রথমে মামলার আসামি ছিলেন পাঁচজন। তদন্তের ভিত্তিতে আরও সাতজনকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আসামিরা হলেন—ই-অরেঞ্জের মূল হোতা শেখ সোহেল রানা, তার বোন সোনিয়া মেহজাবিন, সোনিয়ার স্বামী মাসুকুর রহমান, খালু মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ, বীথি আক্তার, কর্মকর্তা আমানউল্লাহ চৌধুরী, মেহেদী হাসান, নাজমুল আলম রাসেল, মঞ্জুর আলম পারভেজ, এসএসএল চেয়ারম্যান সাবরিনা ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম এবং কর্মকর্তা (চিফ এক্সটার্নাল এফেয়ার্স অফিসার) নূরুল হুদা। এর মধ্যে সোনিয়া, মাসুকুর, আমানুল্লাহ ও নাজমুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে সোনিয়া ও মাসুকুর কারাগারে রয়েছেন। পলাতক আছেন সোহেল রানা। বাকিরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
অপরাধের মাত্রা এবং অভিযুক্তদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে পুলিশ পরিদর্শক জিল্লুর রহমান কালবেলাকে বলেন, একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্থের লেনদেন করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। টাকাগুলো সাধারণ গ্রাহকদের ছিল। অর্ডারের বিপরীতে টাকা নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করে সেই অর্থ নিজেরা আত্মসাৎ করেছে। যারা বিদেশ গিয়েছে, তারা কিছু টাকা বাইরে নিয়ে যেতে পারে। বেশিরভাগ টাকা দেশেই খরচ হয়েছে। যেমন সোহেল রানা ও সোনিয়া মেহজাবিনের ১৮ কোটি টাকার ফ্ল্যাট ক্রোক করেছি। আদালতের আদেশে বাজেয়াপ্ত হবে এবং রাষ্ট্রের অনুকূলে জমা হবে। এসএসএল কমার্সে ৩৪ কোটি টাকা ‘ফ্রিজ’ আছে।
এসএসএল কমার্সের অপরাধ ব্যাখ্যা করে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহকদের কার্যাদেশের বিপরীতে অর্থ প্রথমে আসে পেমেন্ট গেটওয়েতে। পরে এই অর্থ ই-অরেঞ্জকে দিয়েছে এসএসএল। মাধ্যম হিসেবে এ কাজের জন্য ২২ কোটি ১৩ লাখ টাকা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এটা অবৈধ হতো না যদি বিধি ও শর্তানুযায়ী লেনদেন হতো। সন্দেহজনক লেনদেনগুলো এসএসএস ‘রিপোর্ট’ করেনি। ওরা লোভ করেছে যে, ২২ কোটি টাকা পেয়েছে; এই ব্যবসা যদি আরও কিছুদিন চলত তাহলে এখান থেকেই শতকোটি আয় হতো তাদের। এজন্য ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন’ এবং ‘মার্চেন্ট ইনভলমেন্ট ফর্ম’-এর বাইরের লেনদেন রিপোর্ট করেনি এসএসএল। তাদের উচিত ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করা, ই-অরেঞ্জের লেনদেন স্থগিত করা। এজন্য এসএসএল এর কমিশন পাওয়া অর্থ অবৈধ অর্থ হিসেবে চিহ্নিত করে জব্দের সুপারিশ করেছি চার্জশিটে।
গ্রেপ্তারের বাইরে থাকা অভিযুক্তদের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, চার্জশিটে যারা আছেন, আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে পুলিশের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করাতে পারেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এসএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা নুরুল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। প্রতিষ্ঠানটির আইনগত অবস্থান তিনিই অবহিত করবেন বলে জানান সাইফুল ইসলাম। তবে মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না, তাই মন্তব্য করতে পারবেন না বলে জানান নুরুল হুদা।
প্রসঙ্গত, ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা হলে ভারত পালিয়ে যান সেসময়কার বনানী থানার পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা। পরে তাকে বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের চাকরির আড়ালে তিনি ই-অরেঞ্জ শপ পরিচালনা করতেন। ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে দেশটিতে গ্রেপ্তার হন তিনি। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে সাজা দেন আদালত। পরে জামিন পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। তাকে ভারত থেকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। সোহেলের বিরুদ্ধে ঢাকায় ৯টি মামলাও রয়েছে।