চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর ঋণের পরিস্থিতিতে বড় ধস নেমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রতিশ্রুতি কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি কমেছে অর্থছাড়। অন্যদিকে বেড়েছে সুদ-আসলসহ ঋণ পরিশোধের চাপ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে ঋণ করেই এখন ঋণ শোধ করতে হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবরে) বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয়েছে ১২০ কোটি ২০ লাখ ডলার। অথচ এই সময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৪৩ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে ১১০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছিল। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৩৩ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে শুধু আসল পরিশোধ বেড়েছে ২৬ কোটি ডলার।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড ৩৩৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬৮ কোটি ডলার বেশি। এর আগে কোনো অর্থবছরে সরকারকে এত ঋণ পরিশোধ করতে হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছিল। মূলত সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। গত অর্থবছরে শুধু সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪১ কোটি ডলার।
এদিকে, চলতি অর্থবছরে কমে গেছে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ২৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি কমেছে ৯০ শতাংশ।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে পদ্মা রেল সংযোগ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বেশকিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আলাদা চাপ তৈরি হয়েছে। অথচ মেট্রোরেল বাদে পদ্মা রেল সংযোগ ও কর্ণফুলী টানেল থেকে তেমন রিটার্ন আসছে না, যা আয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি মেইনটেন্যান্সে খরচ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে নিজের তহবিল থেকে এসব প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত সরকারের সময় করা ঋণচুক্তির প্রস্তাবগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে পর্যালোচনা করছে। এ কারণে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঋণচুক্তি সম্পন্ন হচ্ছে না। তবে পর্যালোচনা শেষে প্রস্তাবিত ঋণের প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং তখন লক্ষ্য অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি আদায় হবে। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বহুপক্ষীয় এবং বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ ও বাজেট সহায়তার প্রাথমিক আশ্বাস দিয়েছে। চলতি মাসেই বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ঋণচুক্তি হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তুত ও কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় ঋণের প্রতিশ্রুতি এবং অর্থছাড় কমেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অর্থছাড় হয়ে থাকে প্রকল্পের আওতায় কাজের অগ্রগতির ওপর। যতটুকু কাজ হয়েছে, সেটির ওপরই উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থছাড় করে। দুই মাস আন্দোলনের কারণে কাজ না হওয়ায় ঋণের অর্থছাড়ও কম হয়েছে। কাজের অগ্রগতি বাড়লে অর্থছাড় বাড়বে।
জানা গেছে, বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক ঋণের জন্য উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) বেড়েছে। বর্তমানে এসওএফআর ৫ শতাংশের বেশি, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির আগে ১ শতাংশের কম ছিল। আবার বাংলাদেশের বাজারভিত্তিক ঋণও বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশকে এখন সুদ বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণ নিয়ে ঋণ শোধ করলে ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। শুধু ঋণ নিলেই হবে না, এগুলোর ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ ব্যবহার করে রিটার্ন যেন সময়মতো পাওয়া যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর বিদেশি ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রাই লাগবে। তাই বৈদেশিক মুদ্রা আসার ক্ষেত্রে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য পলিসিগুলো ঠিক রাখা দরকার বলে মনে করেন তিনি।