আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৪ এএম
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে আসছে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ

প্রস্তাব থাকবে কর্মঘণ্টা বাড়ানোর
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে আসছে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, শিখন কার্যক্রমের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি, কাঠামোগত উন্নয়নসহ সংকট নিরসন, বৈষম্য দূরীকরণে একগুচ্ছ সুপারিশ করতে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কার কমিটি। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি দূর করা, শিক্ষকদের বেতন বা গ্রেড বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মান বৃদ্ধি, স্কুলের কর্মঘণ্টা বাড়ানো ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের উন্নয়নে এসব সুপারিশ দেওয়া হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের পরামর্শও দেবেন তারা।

প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত কমিটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এরই মধ্যে সুপারিশ প্রণয়নে প্রায় ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করেছে কমিটি। ডিসেম্বরের মধ্যেই সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। পুরো কাজ শেষ করতে জানুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিটির সদস্যরা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে ৯ সদস্যের একটি কনসালটেশন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদকে প্রধান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিদ্যালয়) মো. আসাদুজ্জামানকে সদস্য সচিব করা হয়।

কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক খোন্দকার মো. আসাদুজ্জামান, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সাবেক মহাপরিচালক মো রফিকুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ, গণসাহায্য সংস্থার পরিচালক (শিক্ষা) বেগম সামসি হাসান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরাম মারিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব মোরশেদ এবং শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরুল আলম। কমিটি সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট ৪৫টি সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের কাজ শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবেন তারা।

সংস্কার কমিটি সূত্রে জানা যায়, শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত, শিক্ষক সংকট নিরসন, শিক্ষকদের যথার্থ প্রশিক্ষণ, তাদের বেতন বৈষম্য দূর করাসহ নানা বিষয় নিয়ে কমিটি কাজ করছে। স্কুল নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি কী ভাবছে, কী করা দরকার, কোনো ঘাটতি আছে কি না, শিক্ষকদের বেতনস্কেল কী আছে, কী দরকার, কী করতে হবে, বিদ্যালয়ের জন্য আর্থিক সহযোগিতা কেমন খরচ হচ্ছে, আরও কী করা দরকার—সবকিছু নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। মাঠপর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় কমিটি বেশকিছু ত্রুটি পেয়েছে, সেসব বিষয় সুপারিশ আকারে দেওয়া হবে।

কমিটির সদস্যরা বলছেন, হঠাৎ করে শিক্ষার সংস্কার করা যাবে না। সে কারণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন থাকবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। আবার তাদের পরে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা কী করবেন, সেটিও চিন্তার বিষয়। তবু এই সরকার যদি এক বা দুই বছর ক্ষমতায় থাকে, তারা এর মধ্যে কী করতে পারবে, সেটি চিন্তা করে সুপারিশ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পুরোটাই সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। কমিটি মনে করে, বর্তমান সরকারের মধ্যে সংস্কারের সদিচ্ছা রয়েছে। সেজন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। কাঠামোর মধ্যে আমলারা থাকায় কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। কারণ আমলারা নিজেদের মতো করে চিন্তা করেন। তাদের আগের অভ্যাসগুলো যায়নি। নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে তারা সন্ত্রস্ত থাকেন।

কমিটি সূত্র বলছে, স্বল্প সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন-ভাতার অসংগতি দূর করা। এ বিষয়ে সংস্কার কমিটির ভাবনা হলো, বর্তমানে শিক্ষকরা দশম গ্রেড না পেলেও অনেকেই সেই পরিমাণ বেতন পাচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে এন্ট্রি লেভেলে শিক্ষকদের একটা গ্রেড রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এক বা দুই বছর শিক্ষকতার পর তারা উচ্চতর গ্রেডে যাবে। এরপর কিছু শর্ত পূরণ করে পেশাগত দক্ষতা দেখাতে পারলে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হবে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে ধাপে ধাপে তাদের সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে।

শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়ে কমিটির ধারণা হলো বিপিএড প্রশিক্ষণ খুব বেশি কাজে আসছে না। সেখানে শিক্ষকরা শুধু মেশিনের মতো ক্লাস করছেন। খুব বেশি মাথায় নিতে পারছেন না। শিক্ষক প্রশিক্ষণের ‘মডেল টিচিং-লার্নিং’ মানা হচ্ছে না। ফলে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কাজে আসছে না। তাই প্রশিক্ষণের টিচিং প্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে হবে। এই প্রশিক্ষণ প্রয়োজন অনুসারে হচ্ছে কি না, মান কী, কী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তা দেখতে হবে।

মধ্যমেয়াদি সংস্কারের সুপারিশে পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিকে (পিইডিপি-৫) অন্তর্ভুক্ত করবে কমিটি। পাঁচ বছর মেয়াদি পিইডিপি-৫-এ করণীয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে সংস্কার কমিটি। এ ছাড়া শিক্ষক বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি ও শিক্ষক ঘাটতি এসব কাজে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগুলোর পরামর্শ দিতে যাচ্ছে কমিটি।

সূত্র আরও জানায়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক ও কাঠামোগত সংস্কার। সব সংস্কারের আসল কথা হলো স্কুলে লেখাপড়া কেমন হয়, শিক্ষার্থীরা শিখতে পারে কি না। কারণ জরিপ ও যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, তারা শিখছে না। লিখতে, পড়তে পারছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা লাগবে। এ ছাড়া ভালো শিক্ষক নিয়োগেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা লাগবে। ক্যারিয়ার পাথ ও সুযোগ দেওয়া হলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবে। সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দিয়ে বিষয় বিশেষজ্ঞ, টিম লিডার, প্রধান শিক্ষক, থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, এমনকি ডিজি পর্যন্ত হতে পারবে—সেই ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করতে পারে কমিটি।

শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে সুপারিশ হলো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ হবে। প্রশ্নপত্রের মান নিয়ে আপত্তি রয়েছে কমিটির। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এ প্রক্রিয়া পরিবর্তন আনতে উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করবেন তারা। দেশের ৮০ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় দুই শিফটে চলে। স্কুলের শিখন ঘণ্টাও পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম। কর্মঘণ্টা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলছে সংস্কার কমিটি। এ ছাড়া শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করার প্রস্তাব দেবেন তারা। সেইসঙ্গে বিদ্যালয় শিক্ষাকে এক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ করাসহ বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাব দেবে পরামর্শক কমিটি।

কমিটির সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে পরামর্শক কমিটির প্রধান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ কালবেলাকে বলেন, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা দাবি-দাওয়া আছে। অবকাঠামো, ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা সমস্যাও রয়েছে। আমরা হয়তো সুপারিশ করব, তবে সেখান থেকে কতটুকু বাস্তবায়ন করা হবে, সেটা সরকার জানে। সুপারিশে আমাদের কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষাও থাকবে।

তিনি বলেন, আমরা চাই প্রাথমিকের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা যাতে দায়বদ্ধতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেজন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও শর্ত তৈরি করা দরকার, আমরা সেই সুপারিশ করব। শিক্ষার্থীর শেখার ক্ষেত্রে যে বিরাট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, সেটি কীভাবে পূরণ করা যায়, তা আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা এবং শেখার ঘাটতি সমন্বিতভাবে এই দুই বিষয়ের উন্নতিতে কমিটি কাজ করছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করার চেষ্টা করব। এরপরও কিছু কাজ হয়তো থেকে যাবে। সেজন্য আরও কিছুদিন সময় লাগতে পারে।

কমিটির সদস্য ও গাইবান্ধার শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নূরুল আলম কালবেলাকে বলেন, আমরা উপজেলা পর্যন্ত যাচ্ছি। সব স্তরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছি। নাইটগার্ড থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত সব বিষয় এখানে স্থান পাচ্ছে। এরই মধ্যে আমরা বেশকিছু ত্রুটি পেয়েছি, যা আমাদের সুপারিশে উল্লেখ করব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসির রোডম্যাপ এ সপ্তাহে আর ঘোষণা হচ্ছে না

ভরা মৌসুমেও ইলিশ নেই, হতাশ জেলেরা

গাজীপুরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ

জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করলেন তামিম

পেছনের পকেটে মানিব্যাগ রাখেন? অজান্তেই ডেকে আনছেন যে অসুখ

দিনাজপুরে পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন নিয়ে কর্মশালা

মাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ধরা পড়লেন চীনা গুপ্তচর

নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও ৬ বিভাগে ভারী বৃষ্টির শঙ্কা

সাদাপাথর লুট, এবার তদন্তে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ

মালয়েশিয়া যাচ্ছেন নাহিদ ইসলাম

১০

ছাত্র হত্যা মামলার আসামি ইউএনও রাহুল চন্দ ওএসডি 

১১

ইবনে সিনায় চাকরি, বেতন ছাড়া পাবেন আরও বিভিন্ন সুবিধা

১২

চট্টগ্রামের চকবাজারে ট্রান্সকম ডিজিটালের নতুন শোরুম উদ্বোধন

১৩

পুরুষদের নয়, পিতৃতন্ত্রকে অপছন্দ করি : বাঁধন

১৪

অনুভূতিহীন তথাকথিত কবি-শিল্পীরা ১৫ আগস্ট শোক জানিয়েছে : রিজভী

১৫

সুখবর পেলেন নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়া ক্রিকেটার

১৬

অডিশনের সময়ে বিদ্যা আমাকে গালাগাল করেছিল : বিধু বিনোদ 

১৭

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ফাইবার ও পলিমার সম্মেলন ২৬ ও ২৭ আগস্ট

১৮

দুধ দিয়ে কফি খাচ্ছেন, এই অভ্যাস ভালো নাকি ক্ষতিকর জানাল গবেষণা

১৯

পর্যটক বাড়াতে বিনামূল্যে বিমানের টিকিট দেবে থাইল্যান্ড

২০
X