আবাসিক খাতে মিটারবিহীন গ্রাহকরা মাসে কী পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করেন, তা খতিয়ে দেখতে স্বতন্ত্র কারিগরি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাস বিল বৃদ্ধি সংক্রান্ত তিতাস গ্যাসের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে এই যাচাইয়ের কাজ শেষ করতে চায় বিইআরসি।
এর আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (বিআইডিএস) দিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছিল বিইআরসি। ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, মিটারবিহীন গ্রাহকরা মাসে গড়ে ৫৬ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘আবাসিকে মিটারবিহীন গ্রাহকরা মাসে কী পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করেন, তা আমরা তৃতীয় একটি কারিগরি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাজটি সর্বোচ্চ ছয় মাসের শেষ করা হবে। তিন মাসের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা থাকবে।’
বিআইডিএসের সমীক্ষা প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, ‘রিপোর্টটি পূর্ণাঙ্গ নয়, সাক্ষাৎকারভিত্তিক। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। আমরা চাচ্ছি মতামতসহ পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট।’
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে মিটারবিহীন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এক চুলার বিল নেওয়া হয় মাসে ৯৯০ টাকা, ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ ঘনমিটার। দুই চুলার বিপরীতে বর্তমানে বিল আদায় করা হয় ১ হাজার ৮০ টাকা, ব্যবহারের সীমা ধরা হয়েছে মাসে ৬০ ঘনমিটার। কিন্তু তিতাস গ্যাস কোম্পানি থেকে দাবি করা হচ্ছে, মিটারবিহীন কোনো কোনো গ্রাহকের মাসে সর্বোচ্চ ৯০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহারের তথ্য পেয়েছেন তারা। তাই প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, এই কাজ স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানোর জন্য গত ৬ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিইআরসি চেয়ারম্যান। ওই বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে গ্রাহক ব্যবহার করুক বা না করুক, নির্ধারিত গ্যাস বিল তাকে দিতেই হয়। বিইআরসি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশ দেয় ২০২২ সালের ৫ জুন। ওই আদেশের আগে গণশুনানি হয়। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়।
বিইআরসির আদেশের ১০ মাস পর তিতাস গ্যাস এক চুলার সীমা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৭৬.৬৫ ঘনমিটার এবং দুই চুলার সীমা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন দিয়েছে। আর পরিমাণ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই দামও বেড়ে যাবে। তিতাসের আবেদনে বলা হয়েছে, মিটারবিহীন কমবেশি ২৫ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে কোনো সমীক্ষা বা তথ্য বিশ্লেষণ না করেই ঘনমিটারের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। এতে কারিগরি ক্ষতি বেড়েছে এবং সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তিতাস আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
সারা দেশে প্রায় ৪৪ লাখ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে, তার মধ্যে ৫ লাখের মতো প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীদের তথ্যপ্রমাণ কোনোভাবেই গ্যাস কোম্পানিগুলোর দাবিকে সমর্থন করে না। বেশিরভাগ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গড়ে ৩০ ঘনমিটারের কম গ্যাস ব্যবহার করছেন প্রিপেইড গ্রাহকরা। শুধু সেই পরিসংখ্যান নয়, ২০১৯ সালে বিআইডিএসকে দিয়ে পরিচালিত সমীক্ষায় পাওয়া তথ্যও গ্যাস কোম্পানিগুলোর দাবির সঙ্গে মেলে না। দেশের ছয় কোম্পানির গ্রাহকের ওপর পরিচালিত ওই সমীক্ষার প্রতিবেদন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দাখিল করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ ও তার টিম। সমীক্ষার প্রতিবেদনে ছোট পরিবার, বড় পরিবার, বিতরণ কোম্পানি ভেদে ব্যবহারের তারতম্য এমনকি মিটার ও ননমিটারের মধ্যেও পার্থক্য তুলে ধরা হয়। ১৩ জেলার ১ হাজার ৫৪ আবাসিক গ্রাহকের ওপর পরিচালিত সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, একক চুলার প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকরা ৩৫.৫ ঘনমিটার ও দুই চলার গ্রাহকরা ৫৯.৩ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করছে। আর ননমিটার গ্রাহকরা গড়ে ৫৬ মিটার গ্যাস ব্যবহার করছেন।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ কালবেলাকে বলেন, মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকরা অনেক বেশি গ্যাস ব্যবহার করছে। ক্ষেত্রবিশেষে ১০০ ঘনমিটার পর্যন্ত গ্যাস ব্যবহারের রেকর্ড রয়েছে। তিনি বলেন, প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী ও ননমিটার গ্রাহকের ব্যবহারের মধ্যে অনেক তারতম্য রয়েছে। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহক অনেকটা মিতব্যয়ী হন। তাই তাদের ব্যবহারের পরিমাণ অনেক কম হয়ে থাকে। প্রিপেইড মিটার রয়েছে অভিজাত এলাকায়, তারা অনেক সময় হোটেল-রেস্তোঁরায় গিয়ে খেয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে তুলনা করলে চলে না।
এদিকে গত ৬ জানুয়ারি বিদ্যমান গ্রাহকদের দর অপরিবর্তিত রেখে নতুন শিল্প কারখানার বয়লার ও শিল্প কারখানার জেনারেটরে (ক্যাপটিভ) সরবরাহ গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা।