শাহনেওয়াজ খান সুমন
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নাগরিক অভিযোগ

রাজধানীতে মশক নিধনের চেয়ে প্রচার বেশি

রাজধানীতে মশক নিধনের চেয়ে প্রচার বেশি

গত শতকের চল্লিশের দশকে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণ করে সাড়া ফেলেছিলেন। এরপর আর কোনো মন্ত্রী, মেয়র বা প্রশাসক ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখাতে পারেননি। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগই এখনো সফলতার মুখ দেখেনি। বছরের পর বছর শতকোটি টাকার বাজেট শেষ করেও মশার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাননি রাজধানীবাসী। মশক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার ফলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। ঝরছে প্রাণ। তবে মশার উপদ্রব কমাতে নিজেদের তৎপরতায় ব্যাপক সফলতা দাবি করে আসছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মশক দিবস।

রাজধানীতে দিন-রাতে সমানতালে সইতে হয় মশার উপদ্রব। কী শীত, কী গ্রীষ্ম—সবসময়ই মশার কামড় সহ্য করতে হয় নাগরিকদের। তবে শুধু কামড়ই নয়, বর্ষাকাল এলেই শুরু হয় নতুন অত্যাচার। অন্যান্য সময় কিউলেক্স মশার উপদ্রব চললেও এ সময় প্রাণঘাতী এডিস মশার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। এ দুই ধরনের মশার জন্মস্থলও সাধারণত দুই রকমের হয়ে থাকে। কিউলেক্স মশা খাল-নালার ময়লা পানিতে জন্ম নেয়। আর এডিস মশার জন্ম হয় পরিষ্কার পানিতে, যা ঘরের মধ্যেও থাকতে পারে। ঢাকায় এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় সারা বছরই সকাল-বিকেল ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালনা করে দুই সিটি করপোরেশন। সকালে নালা, ডোবা, লেক ও ময়লা-আবর্জনায় লার্ভিসাইড প্রয়োগ করা হয়। বিকেলে উড়ন্ত মশার জন্য ওষুধ ছিটানো হয়।

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অভিযান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযান চালানো হলেও এর সুফল আসে খুব কম। আবার এমন অনেক এলাকা আছে, যেখানে মাসের পর মাস পার হলেও মশক নিধনকর্মীদের চোখে দেখেন না বাসিন্দারা। এদিকে ঢাকার মশা মারতে প্রতিবছরই নতুন নতুন পদ্ধতি আর প্রকল্প নিচ্ছে দুই সিটি করপোরেশন। এক প্রকল্প ব্যর্থ হলে পরের বছর নেওয়া হচ্ছে নতুন প্রকল্প। মশা নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও যাচ্ছেন মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা। মশা মারতে কামান না দাগালেও ড্রোন ব্যবহার করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহর থেকে ঢাকার এত দিনের মশক নিধন পদ্ধতিকে ‘ভুল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।

এর আগে কয়েক বছর ধরে ড্রেনে তেলাপিয়া ও গাপ্পি মাছ, জলাশয়ে হাঁস ও ব্যাঙ অবমুক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এসব কার্যক্রমও হালে পানি পায়নি। জলাশয়ে ছাড়ার কিছুদিন পরই হাঁসগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি পরিচালিত মশক নিধন অভিযানে সচেতনতামূলক গান পরিবেশন, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেছে। তা ছাড়া চিরুনি অভিযান, লার্ভা পাওয়া গেলে জেল-জরিমানাও করছে সংস্থা দুটি। কাঙ্ক্ষিত সফলতা না পাওয়ায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ওষুধও পরিবর্তন করেছে সিটি করপোরেশন। চলতি সপ্তাহে ডিএনসিসিতে মশার ওষুধ বিটিআই আমদানিতে একের পর এক জালিয়াতি সামনে এসেছে।

ক্ষুব্ধ নাগরিকরা বলছেন, গত ১১ বছরে মশা দমনের পেছনে রাজধানীতে অন্তত ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রতিবছরই এভাবে জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। বিশেষ অভিযান, চিরুনি অভিযান, মোবাইল কোর্ট, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিলসহ নানা কর্মযজ্ঞ। তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দুই সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ বা গবেষণাভিত্তিক কার্যক্রমের বালাই পর্যন্ত নেই। এমন অবস্থায় এমবিবিএস চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট ও মশক নিধনকর্মী দিয়ে চলছে মশা নিয়ন্ত্রণের দায়সারা কার্যক্রম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণা ও কারিগরি জ্ঞান ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকে কীটতত্ত্ববিদের। এমবিবিএস বা অন্য কোনো ডাক্তার তা ঠিকমতো করতে পারবেন না। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম দেখে এটিকে অনেকটা লোক দেখানো বলে মনে হয়। কেননা, ওই সময়ের কার্যক্রমে মশা মারার চেয়ে প্রচার বেশি করা হয়। মেয়র, কাউন্সিলর ও কর্মকর্তারা এসব করে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন।

কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, সিটি করপোরেশন অবৈজ্ঞানিক বা ভুল পদ্ধতিতে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের সঠিক পরামর্শ দিলেও কখনো পরামর্শমতো কাজ করেনি। মশা মারার টাকা সব ড্রেনে গেছে। তিনি বলেন, জনগণের এ অর্থ অপচয় করেছে সিটি করপোরেশন। সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজরা লুটপাটও করেছে। মশা কমা বা বাড়া মূলত আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। মশক নিধনে কার্যকর সুবিধা পেতে হলে সিটি করপোরেশনকে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নগরী শুধু মশার বংশবিস্তারই রোধ নয়, বরং বাসযোগ্যতার মানদণ্ড বাড়ানোরও সহায়ক। তাই সিটি করপোরেশনকে প্রথমেই পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ার কাজে মনোযোগ দিতে হবে। আবার নগরে থাকতে হলে নাগরিকদেরও দায়িত্ব পালন করতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে তারা জনগণের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এটিই একমাত্র সমস্যা। বারবার বলার পরও ঘরে পানি জমিয়ে না রাখার অনুরোধ তারা শুনছেন না। এটি যতক্ষণ পর্যন্ত না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এডিস মশা থেকে মুক্তি মিলবে না।

ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে, টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ডিএনসিসি থেকে তিন স্তরে কাজ করছি। তবে শুধু করপোরেশনের পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জনগণকে সচেতন হতে হবে।

তাহলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না কেন? উত্তরের মেয়র বলেন, এটির উত্তর অ্যান্টামোলজিস্টরা বলতে পারবেন, আমার কাছে নেই। ডেঙ্গু এখন সব দেশেই হচ্ছে। আমি চেষ্টা কম করছি না। চেষ্টা থামিয়েও রাখছি না। আমি সবাইকে বলছি, আর কী করা দরকার বলেন? বাড়ির ভেতরে গিয়ে মশার ওষুধ দেওয়া সম্ভব নয়। লার্ভিসাইডিং রেগুলার প্রোগ্রাম, আরেকটা হচ্ছে হটস্পট ধরে মশা নিধন। আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাকসু নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা করল ছাত্রদল

পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ভয়াবহ বন্যায় মৃত্যু ১৫

১৭ কোটি টাকার জীবনরক্ষাকারী ওষুধ এনে প্রশংসায় ভাসছেন ইন্টার্ন চিকিৎসক 

গয়েশ্বরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার রায় ৪ সেপ্টেম্বর

আজ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা  / ইসির রোডম্যাপে যত পরিকল্পনা   

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ

‘ভারতে পরমাণু হামলা চালাও, ট্রাম্পকে হত্যা করো’ লেখা বন্দুক দিয়ে হামলা

এসএসসি পাসেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকরি

ইউআইইউতে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সপ্তাহ অনুষ্ঠিত

শহীদ কাদরী: নগরসভ্যতার অন্তরালে এক কবির অনন্ত যাত্রা

১০

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ১০ দফা ইশতেহার ঘোষণা ছাত্রদলের

১১

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি রিসার্চ সোসাইটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

১২

নববধূর আত্মীয়ের হাতে বরের মৃত্যু, আনন্দ প্রকাশেই ছুড়েছিলেন গুলি

১৩

জাতীয় পর্যায়ে কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম বাউফলের বুশরা

১৪

১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বুয়েটের সব পরীক্ষা স্থগিত

১৫

বিইউবিটিতে ‘সেরা শিক্ষক পুরস্কার ২০২৫’ প্রদান 

১৬

নামাজরত ব্যক্তির কতটুকু সামনে দিয়ে হাঁটা যাবে?

১৭

‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

১৮

‘মঞ্চ ৭১’ অনুষ্ঠানে উত্তেজনা : লতিফ সিদ্দিকীসহ কয়েকজন আটক

১৯

মেসিকে নয়, আর্জেন্টাইন লিগে নেইমারকেই চান ডি মারিয়া

২০
X