রমজান মাসকে বলা হয় ইবাদত-বন্দেগির বসন্তকাল। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলা হয়, কবরের আজাব বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর এ মাস যে কারণে সবচেয়ে বেশি মাহাত্ম্যপূর্ণ, তা হচ্ছে এ মাসেই মানবজাতির হেদায়েতের জন্য পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন নাযিল করা হয়েছে। এ মাসেই রয়েছে হাজার রাতের চেয়ে সর্বোত্তম রাত লাইলাতুল কদর। এই যে, এত এত মাহাত্ম্য নিয়ে রমজান মাস আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে, আমরা কি আসলেই একে কাজে লাগাতে পারছি? নিজেদের শুধরে নেওয়ার যে সুযোগ আমাদের কাছে এসেছে, নিজের গুনাহগুলোকে মাফ করিয়ে নেওয়ার যে অপার সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে, সে সুযোগগুলোকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজে লাগাতে আমরা পারছি কি? হাদিসে এসেছে রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে এবং সওয়াবের বিশ্বাসে রমজানের রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী সবগুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি রমজানের রাত্রিজাগরণ করে ইবাদতে লিপ্ত থাকে তারও পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি শবে কদরের রাতে ঈমান ও একিনসহকারে ইবাদত করে তারও সবগুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (বুখারি: ৩৮)। তাই রোজা রাখতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তবে কেবল না খেয়ে থাকাই রোজা নয় বরং এর সঙ্গে সঙ্গে সবধরনের গুনাহ থেকেও নিজেকে বিরত রাখতে হবে। রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা, গিবত বা পরচর্চা করা, অন্যের ওপর অন্যায় জুলুম করা হলে সে রোজা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই’। (বুখারি: ১৯০৩)।
এজন্য রোজাকে প্রশিক্ষণের মাসও বলা হয়েছে। এই পূর্ণ এক মাস ব্যক্তি নিজেকে সবধরনের পাপকাজ থেকে বিরত রাখার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে নিতে পারে। এই প্রশিক্ষণ কেবল এই এক মাসের জন্যই নয় বরং এই এক মাসের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাকি ১১ মাসও যেন সে প্রশিক্ষণ অনুযায়ী চলতে পারে তার জন্য। রমজান আমাদের কীভাবে প্রশিক্ষণ দেয়? প্রথমত রমজান আমাদের তাকওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়। মানুষ চাইলেই লুকিয়ে খাবার খেতে পারে; কিন্তু সে কেবল আল্লাহর ভয়েই খাবার গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখে এবং অন্য পাপকাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার’। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)। এ ছাড়া রোজার মাধ্যমে ধৈর্যের প্রশিক্ষণ হয়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাবার খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সারাদিন না খেয়ে থাকা এবং এর পাশাপাশি সব পাপকাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা ধৈর্যের ব্যাপার। দীর্ঘ একটি মাস এভাবে নিজেকে সবধরনের খারাপ কাজ, সবধরনের গুণাহের কাজ থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে মানুষের ধৈর্যের প্রশিক্ষণ হয়। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, কেবল আহারাদি থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। অশ্লীল কথাবার্তা ও অশালীন আলোচনা থেকে দূরে থাকাই আসল রোজা। অতএব হে রোজাদার, যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় বা তোমার সঙ্গে অভদ্রতা করে তাহলে তাকে বলো: আমি রোজাদার। (ইবনে খুজায়মা : ১৯৯৬)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন রোজার দিনে অশ্লীল কথা না বলে এবং শোরগোল ও চেঁচামেচি না করে। কেউ তাকে গালমন্দ করলে বা তার সঙ্গে ঝগড়া করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার’। (বুখারি: ১৯০৪)।
আর সবাই যখন ব্যক্তিগত জায়গা থেকে নিজেকে শুধরে নিতে পারবে সমাজের চিত্র তখন আপনা-আপনি বদলে যাবে। কারণ ব্যক্তি নিয়েই সমাজ আর সমাজের সেই ব্যক্তিরা যদি ঠিক হয়, তাহলে সমাজও ঠিক থাকবে। তাই ব্যক্তিগত জীবন গঠন, নৈতিক মান উন্নয়ন, সমাজের উন্নয়ন এর জন্য রমজান মাস এক সুবর্ণ সুযোগ। রমজান মাসে কেবল পরকালীন কল্যাণই লাভ হয় না, ইহকালীন জীবনেও লাভ করতে পারি অফুরন্ত কল্যাণ।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
মন্তব্য করুন