জাকাত অর্থ পবিত্র হওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। জাকাত সুদবিহীন দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের বাহন এবং নিজের অর্জিত সম্পদ পবিত্র করার মাধ্যম। মহান আল্লাহ জাকাতকে ‘বঞ্চিত ও মুখাপেক্ষীর অধিকার’ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। কেউ যেন নিজের কাছে জমে থাকা সম্পদ কেবল তারই মনে না করে, এতে সমাজের অসহায়-গরিবের অধিকারও যে রয়েছে এবং তা পরিশোধ করা কর্তব্য, সে বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী, আপনি ধনীদের কাছ থেকে (নির্ধারিত খাতের জন্য) সদকা (জাকাত) গ্রহণ করুন। এর মাধ্যমে আপনি তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে থাকবেন।’ (সুরা তওবা: ১০৩)।
অবশ্য জাকাত দেওয়া সবার জন্য ফরজ নয়। কেবল সম্পদশালীদের ওপর ফরজ। এ ব্যাপারে শরিয়তের নির্দেশনা হলো স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন সম্পদশালী মুসলিম নরনারী চন্দ্র বছরান্তে তার জাকাতযোগ্য সম্পদের চল্লিশ ভাগের একভাগ তথা ২.৫ শতাংশ গরিব বা জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রদান করবেন। ইসলামের দৃষ্টিতে সাহেবে নিসাব বা সম্পদশালী হলেন যার কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও প্রয়োজনীয় খাদ্য-বস্ত্রের অতিরিক্ত স্বর্ণ, রুপা, নগদ টাকা ও ব্যবসায়িক সম্পত্তির কোনো একটি বা কয়েকটি রয়েছে, যার সমষ্টির মূল্য সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমান হয়, তিনিই সম্পদশালী এবং তাকে জাকাত দিতে হবে।
কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী গরিব, নিঃস্ব ব্যক্তি, জাকাত আদায় ও বণ্টন ব্যবস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তি, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথের পথিক এবং অভাবী মুসাফির জাকাতের অর্থ ও সম্পদ গ্রহণ করতে পারে। গরিব নিকট আত্মীয়দের জাকাত দেওয়া উত্তম। তবে নিজের সন্তান বা তার অধস্তনকে কিংবা পিতা-মাতা বা তাদের ঊর্ধ্বতনকে, স্বামী-স্ত্রীকে জাকাত দেওয়া যায় না। জাকাত গ্রহীতাকে ‘এটা জাকাতের সম্পদ’ জানানোর প্রয়োজন নেই।
জাকাত বছরের যে কোনো সময় আদায় করা যায়। তবে অনেকে রমজান মাসকে জাকাত আদায়ের উত্তম সময় মনে করেন। কারণ, এ মাসে একটি নফল ইবাদতে একটি ফরজের সমান পুরস্কার মেলে আর একটি ফরজ ইবাদতে মেলে সত্তর গুণ সওয়াব। অবশ্য অভাবীদের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করে রমজান ছাড়াও অন্য সময় জাকাত দেওয়া অশেষ সওয়াবের কাজ।
সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও যারা জাকাত দেবেন না, তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা সোনা-রুপা সঞ্চয় করে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (তওবা: আয়াত ৩৪-৩৫)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ ধনসম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথাবিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুপাশ কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তিলাওয়াত করেন, ‘আল্লাহ যাদের সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য কিয়ামত দিবসে, অচিরেই অকল্যাণকর হবে, যা কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে’ (বুখারি: হাদিস ১৩২১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে সম্পদের জাকাত দেওয়া হয়নি তাকে বিষধর সাপে রূপান্তর করে ওই সম্পদের মালিকের গলায় জড়িয়ে দেওয়া হবে এবং সাপটি তাকে ছোবল দিতে দিতে বলবে, আমি তোমার প্রিয় সম্পদ, গুপ্তধন।’ (বুখারি : ১৪০৩)।
লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
মন্তব্য করুন