রাজশাহী অঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমিতে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। তপ্ত লালমাটির বিস্তীর্ণ এলাকায় পানিস্বল্পতার কারণে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। বিশেষত, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার আটটি উপজেলাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। এই সংকট নিয়ে শুধু বিএমডিএ নয়, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, গবেষক ও ভূতত্ত্ববিদরাও উদ্বিগ্ন।
পানি সংকটের কারণ ও বর্তমান পরিস্থিতি: ভূতত্ত্ববিদ ও পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরের পর বছর গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিস্তর তলানিতে নেমে গেছে। বর্তমানে খরা মৌসুমে অনেক গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। ফলে কৃষক ও সাধারণ জনগণ চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছে। গবেষকদের মতে, এই অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠছে, যা পরিবেশ ও কৃষির জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
সংকট মোকাবিলায় বিএমডিএর উদ্যোগ: এই সংকট নিরসনের লক্ষ্যে বিএমডিএ শস্য বিন্যাস নীতি গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে সেচনির্ভর ফসল চাষ কমিয়ে কম পানি চাহিদাসম্পন্ন ফসলের দিকে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ ছাড়াও, সেচের সময়সীমা নির্ধারণ করে পানির অতিরিক্ত ব্যবহার রোধ করা হচ্ছে। সেচ ঘণ্টা নির্ধারণের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও সমাধান প্রক্রিয়া: বিএমডিএ, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানিসম্পদ পরিকল্পনা বিভাগ ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ একত্রে এই সংকট নিরসনের উপায় খুঁজছে। সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের আট উপজেলার খরাপ্রবণ এলাকার পানি সংকট পরিস্থিতির ওপর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিএমডিএর চেয়ারম্যান ড. এম আসাদুজ্জামান এই সংকটের ভয়াবহতা তুলে ধরেন এবং সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের মতামত চান।
পানি সংকটের কারণ ও এর প্রভাব: বরেন্দ্র ভূমির মাটির পানি শোষণ ও আর্দ্রতা ধারণক্ষমতা কম, ফলে এখানকার ভূগর্ভস্থ পানিরস্তর দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের হার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ কম। আশির দশকে বিএমডিএ গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটায়, ফলে একসময় যেখানে বছরে মাত্র একটি ফসল হতো, সেখানে এখন বছরে তিন থেকে চারটি ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নিচে নেমে গেছে।
খরা মৌসুমে সেচ সংকট ও শস্য বিন্যাস পরিকল্পনা: সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, নাচোল, গোমস্তাপুর, নওগাঁর নিয়ামতপুর, সাপাহার ও পোরশা উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানিস্তর আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। গভীর নলকূপ থেকেও পানি না ওঠার কারণে কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। তাই বিএমডিএর বিশেষজ্ঞরা ধানের পরিবর্তে গম, ভুট্টা, মসুর ডাল, পেঁয়াজসহ কম পানিনির্ভর ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছেন।
সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা: বিশেষজ্ঞদের মতে, বরেন্দ্র অঞ্চলে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। বিএমডিএ ইতোমধ্যে যে শস্য বিন্যাস পদ্ধতি চালু করেছে, তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর পুনরুদ্ধার হতে পারে।
সেচ রেশনিং ব্যবস্থা: বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের তিন জেলার আট উপজেলাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে সেচ ঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেচ নীতিমালা অনুযায়ী, আসন্ন বোরো মৌসুমে গভীর নলকূপ এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৯৬০ ঘণ্টা চালানো হবে। একটি গভীর নলকূপ পুরো বছরে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯৬০ ঘণ্টা চলতে পারবে। শস্য বিন্যাস নীতির আওতায় এক মৌসুমে বোরো ধান চাষের পর পরবর্তী মৌসুমে কম সেচনির্ভর ফসল চাষ করতে হবে।
মন্তব্য করুন