জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় জটিলতা তৈরি হয়। একই সঙ্গে সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) আসে বড় পরিবর্তন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে ৪৪, ৪৫, ৪৬ ও ৪৭তম বিসিএস দ্রুত শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে এসব পরীক্ষা পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে কমিশনকে। কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, একেকটি বিসিএসের মাঝে আগের মতো কয়েক মাস সময় পাচ্ছেন না প্রার্থীরা। এ কারণে কিছু প্রার্থী আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের প্রধান দাবি, একটি বিসিএস সম্পন্ন করে পরবর্তী বিসিএসের কাজ শুরু করা হোক। তবে পিএসসি বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সম্ভব নয়।
জানা গেছে, ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শেষ না হতেই ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার পিএসসি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন শতাধিক চাকরিপ্রার্থী। পরে পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ছয়জন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন পিএসসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম। পিএসসি সিদ্ধান্ত নিতে সময় চাইলে, আন্দোলনকারীরা ১১ এপ্রিল বিকেল ৫টার মধ্যে লিখিত পরীক্ষা পেছানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে বলেন, অন্যথায় চেয়ারম্যানসহ কমিশন সদস্যদের পদত্যাগের দাবিতে একদফা আন্দোলনের ঘোষণা দেন তারা।
প্রার্থীদের দাবির মধ্যে রয়েছে—৪৪তম বিসিএসের বাকি ভাইভার পূর্ণাঙ্গ সময়সূচি প্রকাশ করে মে মাসের মধ্যে তা শেষ করা, জুনে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পদে সংখ্যা বাড়িয়ে সবাইকে চাকরি দেওয়া, ২০২৩ সালের নন-ক্যাডার বিধিমালা বাতিল, ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশের পর দেওয়া এবং ২০২৫ সালের মধ্যে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা ৪৪তম চূড়ান্ত ফল ও ৪৫তম লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর নেওয়া এবং ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ৪৬তম লিখিত পরীক্ষার অন্তত দুই মাস পরে নেওয়া।
বর্তমানে ৪৪তম বিসিএসের ভাইভা চলছে। ২০২১ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত এই বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা এক দফায় শুরু হলেও ১৮ নভেম্বর তা বাতিল করে কমিশন, পরে ২২ ডিসেম্বর থেকে ফের শুরু হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও সরকার পতনের পর এ পরীক্ষা দুবার স্থগিত হয়। ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয় ২০২৩ সালের ১৯ মে, যার ফল প্রকাশ হয় ৬ জুন। লিখিত পরীক্ষা হয় ২৩ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। এর ফল ৩০ জুনের মধ্যে প্রকাশের কথা জানিয়েছেন পিএসসি চেয়ারম্যান।
৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হবে আগামী ৮ মে। এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৬ এপ্রিল, ফল প্রকাশ হয় ৯ মে। প্রাথমিকভাবে ২৮ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণ করা হলেও তা স্থগিত হয়। পরে উত্তীর্ণদের সঙ্গে সমসংখ্যক নতুন প্রার্থীকে যুক্ত করে ফের ফল প্রকাশ করা হয়। ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নির্ধারিত রয়েছে ২৭ জুন।
চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের সময় কিছু বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হলে পিএসসি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, কমিশনের মত গুরুত্বপূর্ণ কেপিআই এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা গ্রহণযোগ্য নয় এবং পুনরাবৃত্তি হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিসিএস ছাড়াও নন-ক্যাডার, সিনিয়র স্কেল ও বিভাগীয় পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র মুদ্রণ এবং পরীক্ষাকেন্দ্র নির্ধারণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পিএসসির নিজস্ব অবকাঠামো না থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রেসের ওপর নির্ভর করতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসএসসি, এইচএসসি এবং অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি পরীক্ষাকেন্দ্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে পিএসসি মনে করে, ৮ মে ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা পেছানো বাস্তবসম্মত নয়।
পিএসসির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৮ মে ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা নির্ধারিত সময়েই হবে। তবে পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে মে ও জুনে নির্ধারিত ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীদের ভাইভার নতুন সময়সূচি আগামী ১৬ জুনের পর প্রকাশ করা হবে।
এদিকে, আলটিমেটামের দিন সকালে ফের পিএসসি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন চাকরিপ্রার্থীরা। বিক্ষোভকালে কমিশন কার্যালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠিচার্জ করে এবং কয়েকজনকে আটক করে।
পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পিএসসি চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে জরুরি সভা বসে। যদিও চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, এক সদস্য বলেন, ৪৪তম ও ৪৬তম বিসিএস যাতে ওভারল্যাপ না হয়, সেজন্য ভাইভা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রার্থীদের স্বস্তির জন্যই এ সিদ্ধান্ত। তবে লিখিত পরীক্ষা পেছানো সম্ভব নয়। এতে পরবর্তী শিডিউল ভেঙে পড়বে, ঈদের ছুটির কারণে কেন্দ্র ও প্রেসও পাওয়া যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ৪৫তম বিসিএসের ভাইভা জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে শুরু হতে পারে। ফলে ৪৬তম লিখিত পরীক্ষা দুই মাস পেছালে ফের ওভারল্যাপ হবে। সেইসঙ্গে প্রার্থীদের আবাসন ও যাতায়াতের সমস্যাও বাড়বে। তাই কমিশন টাইট শিডিউলেই এগোতে বাধ্য।
এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গতকাল পিএসসি চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বিসিএস পরীক্ষাগুলোর সময়সূচি সুনির্দিষ্ট করে জানাতে এবং বছরে একটি বিসিএস সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছে। স্মারকলিপি প্রদান করেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন, যুগ্ম সদস্য সচিব মো. মিরাজ মিয়া এবং ফয়সাল মাহমুদ শান্ত।
মন্তব্য করুন