জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সক্ষমতা থাকার পরও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক এ জ্বালানির জোগান দিতে অতি উচ্চ দামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এই কারণ দেখিয়ে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। তারপরও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। গ্যাসের অভাবে অনেক কেন্দ্র অলস বসে আছে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরকার বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী খুলনার রূপসায় ৮শ মেগাওয়াট ক্ষমতার কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে এলপিজি ব্যবহার করা হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে এলপিজি ব্যবহারের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এটা নিয়ে আরও ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে হবে। একটা স্টাডি হয়েছে, তাতে ফলাফল ভালো আসেনি। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বুয়েটের দুজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
পিডিবি চেয়ারম্যান বলেন, রূপসা পাওয়ার প্লান্টটি অপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। গ্যাসের নিশ্চয়তা ছিল না। এখন কেন্দ্রটি বসে আছে। তাই বিকল্প কোনো জ্বালানি দিয়ে কেন্দ্রটি চালানো যায় কি না, তাই পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
জানা গেছে, নির্মাণের পর খুলনার রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জ্বালানির অভাবে এখনো উৎপাদনে আসতে পারেনি। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও গ্যাসের অভাবে কেন্দ্রটি চালু করা যায়নি। মূলত প্রাকৃতিক গ্যাসে চালুর জন্য নকশা করা হয়েছিল রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু নির্মাণের পরও গ্যাস সংকটের কারণে চালু করা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সক্রিয়ভাবে দেশের সাধারণত ব্যবহৃত জ্বালানি বাদে বিকল্পগুলো অনুসন্ধান করছে। বিশেষ করে রূপসার মতো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য। রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এলপিজি ব্যবহার সফল হলে এবং মূল্য কম হলে তাহলে অন্যান্য কেন্দ্রেও ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এলপিজি ও আমদানি করা এলএনজি ব্যবহারের খরচ এবং সম্ভাব্যতা তুলনাও করতে হবে।
এর আগে রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিবেদন দিতে গত বছরের ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) কে এম আলী রেজাকে প্রধান করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করে কমিটি। এগুলো হলো নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রদত্ত শিডিউল অনুযায়ী আপস্ট্রিম গ্যাস রেশনিংয়ের মাধ্যমে এলেঙ্গা প্রান্তে গ্যাসের চাপ ৪১০ পিএসআইর অধিক হলে, সিরাজগঞ্জ ও ভেড়ামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রেখে রূপসা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কমিশনিং সম্পন্ন করা যেতে পারে। এ ছাড়া রূপসায় গ্যাস সরবরাহ করতে হলে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের গ্যাসচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে। রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলেও গ্যাসচালিত ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পাবে। সামগ্রিক বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখার প্রয়োজন হবে। এর ফলে আনুমানিক ১০৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে।
সুপারিশে আরও উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকায় এবং পেট্রোবাংলা থেকে ১৫শ থেকে ১৬শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চাহিদার বিপরীতে ১২শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দের প্রক্ষেপণ রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ফলে রূপসা ৮শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট কমিশনিংয়ের পর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এ স্থাপনা যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য আপস্ট্রিম গ্যাস রেশনিংয়ের মাধ্যমে এলেঙ্গা প্রান্তে প্রয়োজনীয় গ্যাসের চাপ নিশ্চিত করে মাসে এক থেকে দুদিন পার্ট লোডে পরিচালনা করার জন্য ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যেতে পারে।
পিডিবির হিসেবে, সর্বোচ্চ চাহিদার সময় তাদের ৪৭টি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট এমএমসিএফডি প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজন এবং গ্রীষ্মকালে কমপক্ষে ১ হাজার ৫৫৮ মিলিয়ন ঘনফুট প্রয়োজন। তবে, পিডিবি বর্তমানে মাত্র এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন বজায় রাখার জন্য তাদের বিকল্প জ্বালানি অনুসন্ধানে বাধ্য করছে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২২ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) রূপসার এই ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। একনেকে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ২ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা আর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। একনেকে অনুমোদন পেয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ ২০১৮ সালের ২ আগস্ট এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে। প্রাথমিকভাবে ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে কেন্দ্রটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও, ক্রমাগত বিলম্ব এবং গ্যাস সরবরাহের অভাবে সময়সীমা ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
মন্তব্য করুন