সোমবার, ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ ভাদ্র ১৪৩২
রকি আহমেদ
প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৯ জুন ২০২৫, ০৯:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকার আদালতপাড়ায় ঢিলেঢালা নিরাপত্তা

সাত মাসে তিনবার আসামি পলায়ন
ঢাকার আদালতপাড়া
ছবি : সংগৃহীত

পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকার বিচারিক আদালতে ফের আসামি পালানোর ঘটনা ঘটেছে। গত সাত মাসে এ নিয়ে তিনবার আসামি পালাল। একের পর এক আসামি পলায়নে আদালতপাড়ার নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকার আদালতপাড়া ঢিলেঢালা নিরাপত্তায় চলছে বলে অভিযোগ অনেকের।

সরেজমিন, পুরান ঢাকার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত এ আদালতপাড়ায় পদে পদে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি ফুটে ওঠে। ভিআইপি আসামিদের জন্য কঠোর নিরাপত্তা দেখা গেলেও অন্য আসামিদের বেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে উদাসীন। চার থেকে পাঁচ আসামিকে আদালতে আনা-নেওয়ার দায়িত্বে থাকেন মাত্র একজন পুলিশ সদস্য। অথচ একজন আসামির জন্য থাকার কথা একজন পুলিশ সদস্য। হত্যা মামলা বা সন্ত্রাস দমন আইনে করা মামলার ভয়ংকর আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরানো ও পেছনে হাতমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অনেক আসামিকে হাতে লাগানো হচ্ছে পুরোনো হাতকড়া। এমন নিরাপত্তাহীনতার সুযোগ নিয়েছে স্কুলছাত্র জিসান হোসেন হত্যা মামলার আসামি শরিফুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার ধাতব বস্তু দিয়ে হাতকড়া খুলে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় এ আসামি।

এ ঘটনার আদালতের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা গেছে, মামলার শুনানি শেষে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে দায়িত্বরত এক পুলিশ কনস্টেবল আসামি শরিফুলসহ চার আসামিকে দঁড়ি দিয়ে বেঁধে আদালতের হাজতখানার দিকে যাচ্ছিলেন। শরিফুলকে ডান্ডবেড়ি পরানো ছিল না। সাধারণ আসামিদের মতোই সামনে তার এক হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। আদালত ভবনের নিচে সিঁড়ির কাছে পৌঁছালে ওই আসামি কৌশলে হাতকড়া খুলে দৌড় দেয়। বাকি তিন আসামিকে সামাল দেবেন নাকি পলায়নরত আসামিকে ধরবেন—এটা ভাবতে ভাবতে বা অন্য পুলিশ সদস্যদের কাছে তিন আসামিকে রেখে পলায়নরত আসামিকে ধরতে গিয়ে ততক্ষণে আসামি শরিফুল ছুটে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গা ঢাকা দেয়।

ঢাকার বিচারিক আদালত থেকে আসামি পালানোর এ ঘটনা নতুন নয়। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চত্বর থেকে পালিয়ে যায় শহিদুল ইসলাম নামে এক আসামি। সে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার দলবদ্ধ এক ধর্ষণ মামলার আসামি। সেও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কৌশলে হাতকড়া খুলে পালিয়ে যায়। অবশ্য এক মাস পর ১৩ মার্চ নেত্রকোনার কলমাকান্দা থেকে তাকে র্যাব আটক করে। এ ছাড়া গত বছরের ১৬ নভেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত থেকে আরিফুল ইসলাম নামে ডাকাতি মামলার এক আসামি পালিয়ে যায়। এ আসামি হাতকড়া ও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কৌশলে আদালত কক্ষ থেকে পালিয়ে যায়। তাকে গ্রেপ্তারের কোনো তথ্য এখনো মেলেনি।

এদিকে আদালতের হাজতখানা ও প্রসিকিউশন বিভাগের দায়িত্বরত কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা জানান, হাজতখানায় পুলিশ সংকট রয়েছে। সরকার পতনের পর আসামি বেড়েছে। রাজনৈতিক ভিআইপি আসামিদের নিরাপত্তা দিতে গেলে বেশি পুলিশ সদস্য লাগে। এ সময় অন্য মামলার চার থেকে পাঁচজন আসামির আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে মাত্র একজন করে পুলিশ দেওয়া হয়। সব আসামির হাতে হাতকড়ার সঙ্গে দড়ি লাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এতজন আসামি পুলিশকে মারধর করে একেকজন একেকদিকে পালিয়ে গেলে করার কিছু থাকে না। পুলিশ সদস্য বৃদ্ধিসহ আসামিদের হাতে লাগানো হাতকড়াও নতুন দরকার। পুরোনো হয়ে যাওয়ায় সহজেই আসামিরা খুলে পালিয়ে যাচ্ছে। বিগত দুটি ঘটনায় আসামিরা হাতকড়া খুলে পালিয়ে গেছে।

এদিকে আদালতে অবাধে ঢুকছে হকার, ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারী-পকেটমাররা। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার সিএমএম আদালতে সরেজমিন দেখা যায়, দুপাশের দুই গেট দিয়ে কোনো ধরনের বাধা বা তল্লাশি ছাড়াই আদালত চত্বরে ঢুকছে সবাই। প্রধান ফটকে পুলিশ সদস্য থাকলেও কাউকে কোনো বাধা দেওয়া হচ্ছে না। দ্বিতীয় ফটকে নেই কোনো পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া সিএমএম আদালতের সামনের সরু রাস্তার ওপর ডাবের ভ্যান, কেটে বিক্রি করা বিভিন্ন ফল ও বাদামের হকার অস্থায়ী দোকান বসতে দেখা যায়। আদালতে বিচারপ্রার্থীদের ভিড়ের মধ্যে যত্রতত্র অস্থায়ী এসব দোকান নিরাপত্তার জন্য বাড়তি গলার কাঁটা। এ ছাড়া ঢাকার সিজেএম আদালত প্রাঙ্গণেও রয়েছে দোকান। এ আদালতে ঢুকতেও কোনো তল্লাশির ব্যবস্থা নেই। ঢাকা জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণের ফটকেও পুলিশের কোনো বাধা নেই। গত বৃহস্পতিবার আসামি পালিয়ে যাওয়ার সময়ও ফটকে কোনো পুলিশের বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় হাজিরা দিতে আসা বিচারপ্রার্থীরা ভিড়ের ভেতর পকেটমার-ছিনতাইয়ের শিকারের ঘটনা প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। এদিকে ২০২২ সালে ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে দুই জঙ্গি আসামিকে ছিনতাইয়ের চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর আদালতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়। সরকার পতনের পর ভিআইপি আসামির জন্য নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। তবে ভিআইপি আসামির ক্ষেত্রে ছাড়া ঢাকার আদালতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিত্র একেবারেই ঢিলেঢালা।

ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের এডিসি মাইন উদ্দিন বলেন, ‘আসামি নিয়ে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে কাজ করে আমাদের প্রসিকিউশন বিভাগের পুলিশ। তাদের কাছে কোনো অস্ত্র থাকে না। একজন আসামির জন্য একজন পুলিশ থাকার কথা; কিন্তু আমাদের প্রসিকিউশন বিভাগে পুলিশ সংকট রয়েছে। যে আসামি পালিয়ে গেছে, তার হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। সে ধাতব কিছু দিয়ে হাতকড়া লুজ করে কৌশলে খুলে ফেলে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া আদালত চত্বরের হকার উচ্ছেদ বা গেটের নিরাপত্তা ডিএমপির লালবাগ বিভাগ বা কোতোয়ালি থানা পুলিশের দায়িত্ব বলেও জানান তিনি। পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, আসামিকে আনা-নেওয়ার সময় অনেক পুলিশ সদস্য গাফিলতি করেন। আসামি পলায়নের ঘটনায় কোনো গাফিলতি আছে কি না, সেটা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আদালতে নিরাপত্তা জোরদারে পুলিশ সদস্যদের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি বলেন, আসামি পলায়নে পুলিশের দুর্বলতা রয়েছে। বর্তমানে আদালতে যেসব পুলিশ সদস্য নিয়োজিত, তারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। কীভাবে আসামি আনা-নেওয়া করতে হয় জানেন না। ঠিকমতো অনেকে হাতকড়া পরান না। অনেক সময় শুধু আসামির হাত ধরে আসামি নিয়ে যান। তাদের জন্য প্রসিকিউশন বিভাগ থেকে সপ্তাহে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। দক্ষতা বাড়াতে কাউন্সেলিং করা উচিত। এ ছাড়া প্রসিকিউশন বিভাগে পুলিশ লোকবল সংকট রয়েছে বলে জানান তিনি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বুটেক্স সাংবাদিক সমিতির ৯ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত

টানা ৮ ঘণ্টা অবরুদ্ধ জবির ভিসি

৬৪ জেলার নেতাকর্মীদের নতুন বার্তা দিল এনসিপি

ম্যানইউর জয়হীন ধারা অব্যাহত, এবার ফুলহামের মাঠে ড্র

ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা-পেশাজীবীদের নিয়ে ‘আগামীর পথ’ অনুষ্ঠিত

প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের অনন্য কীর্তি

জুলাই যোদ্ধা শহীদ তানভীরের চাচা খুন

ভরা জোয়ারে ডুবে যায় বিদ্যালয়, শঙ্কায় অভিভাবক-শিক্ষার্থী

যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন তৌহিদ আফ্রিদি

তারের পর এবার চুরি হলো সেতুর রিফ্লেক্টর লাইট

১০

‘এবার আমাদের পালা’ স্বরূপ আচরণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে : টিআইবি

১১

ভূমি অধিগ্রহণে আটকে আছে ইউলুপ, ইউটার্নে মরছে মানুষ!

১২

কনে দেখতে যাওয়ার পথে নৌকাডুবি : নিখোঁজ দুজনের মরদেহ উদ্ধার

১৩

থাইল্যান্ডের ক্লাবে আবার ভাইরাল ‘কাঁচা বাদাম গার্ল’ অঞ্জলি

১৪

চাকসুতে সমকামিতা সমর্থক ও মাদকাসক্তদের প্রার্থিতা বাতিলের দাবি

১৫

ঠাকুরগাঁওয়ের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১

১৬

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১০ শয্যার এইচডিইউ উদ্বোধন

১৭

এবার তৌহিদ আফ্রিদি গ্রেপ্তার

১৮

রাকসুতে প্রথম দিনে ৫ জনের মনোনয়ন সংগ্রহ 

১৯

ফিলিস্তিনিদের ৩০০০ জলপাই গাছ উপড়ে ফেলল ইসরায়েলি বাহিনী

২০
X