চরম তারল্য সংকটের মধ্যেও সরবরাহ ঠিক রাখতে গ্যাসের বকেয়ার রেকর্ড পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেছে পেট্রোবাংলা। অর্থ বিভাগ থেকে ছাড় করা টাকায় সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসের এই বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, সেপ্টেম্বর মাসের জন্য দেশের জ্বালানি খাতে তাদের সর্বোচ্চ বৈদেশিক অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এর পরিমাণ হচ্ছে ৪১৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তারা বলেন, এর আগে কখনো এই পরিমাণ বকেয়া এক মাসে জমা হয়নি এবং পরিশোধও করা হয়নি। পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ তথ্য জানান।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা প্রক্রিয়াকরণ খরচসহ ১১টি এলএনজি কার্গোর জন্য ৩৫২ মিলিয়ন ডলার, শেভরন বাংলাদেশকে ৩৭ মিলিয়ন ডলার এবং সুদসহ ঋণ পরিশোধের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি)-কে ৩০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছি। এটা এক মাসের বকেয়া পরিশোধে রেকর্ড।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হ্রাসের বিপরীতে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে চলতি মাসে অতিরিক্ত তিন কার্গো এলএনজি আমদানি করার কারণে বৈদেশিক অর্থ পরিশোধের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে ২০২৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে এই চাপ কমে আসবে। সূত্রমতে, আগস্টে একক মাসের বিল ছিল প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পেট্রোবাংলা ৩০ জুনের সময়সীমার দুই মাস আগেই সব বৈদেশিক বকেয়া দায় নিষ্পত্তি করে। অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যভার গ্রহণের শুরুতে বকেয়া দায়ের পরিমাণ ছিল ৭৩৭ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৮ হাজার ৭০২ কোটি ৩ লাখ টাকা।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, পেট্রোবাংলার পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, গ্যাস কোম্পানিগুলোর জন্য মাসিক আদায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, শেষ ব্যবহারকারী পর্যায়ে আদায় উন্নত করা, বিদ্যুৎ ও সার খাতের বকেয়া পুনরুদ্ধারে নিয়মিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা এবং এলএনজি আমদানির জন্য স্ট্যান্ডবাই লেটার অব ক্রেডিট (এসবিএলসি) ইস্যু করা ব্যাংকগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি করা।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার অর্থ পরিশোধে সহায়তা করার জন্য বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। আর বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে ২ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকে আরও সহজ করেছে। চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসের মধ্যে পেট্রোবাংলা সম্মিলিতভাবে ১ হাজার ৪৪৫ দশমিক ৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৭ হাজার ৮৫৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা পরিশোধ করার মধ্যদিয়ে সব বকেয়া পরিশোধ করা হয়।
পেট্রোবাংলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বৈশ্বিক তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বাজারে প্রবেশের পর থেকে বাংলাদেশ ৩১ দশমিক ৬১ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানিতে ১৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে।
আমদানির পরিমাণ ২০১৮ সালের শূন্য দশমিক ৬৭ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮০ মিলিয়ন টন। সেই সঙ্গে আমদানির বিলও বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে এই ক্রমবর্ধমান আর্থিক বোঝা তৈরি হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার ৬৯৪ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে কমে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রায় ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যয়বহুল আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
এখানে উল্লেখ্য, ভবিষ্যতে পেট্রোবাংলা জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে কাঠামোগত সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে রয়েছে—অনুসন্ধান ও উন্নয়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণে সিস্টেম লস হ্রাস, ২০২৬ সাল থেকে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তি সুরক্ষিত করা, এলএনজি আমদানি এবং গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি চাওয়া এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে কর ছাড়ের অনুরোধ করা।
মন্তব্য করুন